বিশ্ববাজারে কমছে, দেশে কমছে না কেন

বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে দেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটা যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু যখন বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম কমতির দিকে, তখন দেশীয় বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, কিংবা বিশ্ববাজারের কাছাকাছি হারেও না কমা শুধু অস্বাভাবিক নয়, উদ্বেগজনকও বটে।

দুর্ভাগ্য হলো আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা বাজার—কোনোটিই যুক্তির ধার ধারে না। সবখানে জবরদস্তি চলছে। যে যখন যেখান থেকে পারে ফাও মুনাফা কামিয়ে নিচ্ছে। আর পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি ‘দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স’-এর একটি বৈঠক হয়। সেখানে আটটি নিত্যপণ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) উত্থাপিত প্রতিবেদনে যেসব তথ্য ও পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে, তা স্বস্তিদায়ক নয়। পণ্যগুলো হলো গম (আটা), চিনি, সয়াবিন তেল, পাম তেল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা।

সংস্থাটি এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছে, বিশ্ববাজারে কিছু কিছু নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, দেশের বাজারে বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। আবার বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম যে হারে কমেছে, দেশের বাজারে সে হারে কমেনি। দু-একটি পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে বাড়তি।

দেশীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকেরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিচ্ছেন। সেটাই যদি হবে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে কমে না কেন? এর উত্তরও পাওয়া গেল বিটিটিসির পর্যবেক্ষণে। তারা বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, প্রতিযোগিতার অভাব, নিয়মিত বাজার তদারকি না করা, সময়মতো পণ্য বন্দর থেকে খালাস না হওয়াকে চিহ্নিত করেছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ ডলার–সংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন।

সরকারের মন্ত্রীরা নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য বাজার ‘সিন্ডিকেটে’র (অসাধু জোট) কথা বলেন। কিন্তু সেই ‘সিন্ডিকেটে’র আকার ও রূপ কী, সেটা কখনো আমরা জানতে পারি না। সম্প্রতি একজন প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রীদের মধ্যেও ‘সিন্ডিকেট’ আছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

সম্প্রতি সরকার সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি যথাক্রমে ১০ টাকা ও ২ টাকা কমিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এই দুটি পণ্যের দাম এর চেয়ে অনেক বেশি কমেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম কমেছে প্রতি টনে ৩৫ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটার দাম ২৫ শতাংশ এবং খোলা আটার দাম ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

আবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার কারণেও পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য কষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার দুই সপ্তাহ পর তারা আমদানির পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ইতিমধ্যে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়। আমদানি শুরু হয়েছে। তবে দাম খুব বেশি কমেনি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাবের) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, সরকারের নীতি-পরিকল্পনা ব্যবসায়ীদের পক্ষে। ফলে মুষ্টিমেয় মানুষ লাভবান হচ্ছে।

মুষ্টিমেয় মানুষকে লাভবান করতে সরকার বৃহত্তর জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। ডলার-সংকট মোকাবিলায়ও সরকারকে অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।

অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সরকার ডলারের জোগান দিতে পারে না।

অথচ মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের বিদেশভ্রমণের নামে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হয়।

এখনই বাজারের লাগাম টানতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।