শান্তি ফেরাতে সব পক্ষের ধৈর্য ধারণ জরুরি

সম্পাদকীয়

পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার সংঘাত, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা একই সঙ্গে দুঃখজনক ও গভীর উদ্বেগের। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্যার বয়স অনেক বছরের এবং বিগত সময়ে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কেউই সেখানকার সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর প্রতি মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। সমস্যা ও অসন্তোষ জিইয়ে থাকায় পার্বত্য অঞ্চলে নানা সময়ে অস্থিরতা ও রক্তপাতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত বুধবার খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ওই দিন বিকেলে সেখানকার পাহাড়ি ও বাঙালির এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘাত বাধে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ারের দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। ১০২টি দোকান পুড়ে যায়, যার মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালিদের ২৪টি দোকান রয়েছে। দীঘিনালার সংঘাতের জেরে উত্তেজনা খাগড়াছড়ির অন্য উপজেলাগুলোয়ও ছড়িয়ে পড়ে। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং তিনজন পাহাড়ি যুবক নিহত হন।

শুক্রবার সকালে খাগড়াছড়ি থেকে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটি সদরে। পাহাড়ি ছাত্র-তরুণেরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে বাঙালিদের সঙ্গে সংঘাত বেধে যায়। এ সংঘাতে পাহাড়ি এক তরুণ নিহত হন। পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানে আগুন দেওয়া হয়। দুই পার্বত্য জেলার সংঘাত ও সহিংসতায় দুই পক্ষের বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার দুই জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেনা, পুলিশ ও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল গতকাল শনিবার রাঙামাটি সফর করে। এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বার্তায় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

আমরাও মনে করি, সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতের স্বার্থে সব পক্ষকেই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাতে এবারও সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাঁদের বাড়িঘর ও দোকানপাট ভস্মীভূত হয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেকে। আতঙ্কে পাহাড়িদের অনেকে বাড়িঘরছাড়া হয়েছেন। যেকোনো মূল্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীল পরিবেশ ও শান্তি ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের যেমন ভূমিকা আছে, একইভাবে পাহাড়ি ও বাঙালি সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের গুজব ও অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে। এ ক্ষেত্রে সবার সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতা’ ৭২ ঘণ্টার ব্লকেড কর্মসূচি দিয়েছে। সেখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনো থমথমে। উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত করা না গেলে সেটা বড় কোনো সংঘাতের রূপ পেতে পারে। আমরা মনে করি, পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে ও সেখানে শান্তি ফেরাতে পাহাড়ি ও বাঙালি দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলেছে। পাশাপাশি যাঁদের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তঁাদেরও যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন।