সংসদে উত্থাপিত বিলের (জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিল ২০২৩) ১৫ ধারায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভোটার তালিকা করার কথা বলা হয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশন (ইসি) আইন অনুযায়ী, ভোটার তালিকা করার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে আছে, ‘নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের জন্য সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন এবং ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন। ২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনেও ইসিকে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা-সংক্রান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়।
সংসদে উত্থাপিত বিলের ৩০ ধারায় বলা হয়, আগের আইন রহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাছে রক্ষিত এবং নির্বাচন কমিশনের সংগ্রহ করা জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্ত নিবন্ধকের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সরকার বিগত নির্বাচন কমিশনের আমলে যখন জাতীয় পরিচয়পত্রের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়, তখনো কমিশন থেকে মৃদু আপত্তি জানানো হয়েছিল। বর্তমান কমিশন নীতিগতভাবে বিষয়টি মেনে নিলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ইসি বলেছে, এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরে তাদের আপত্তি নেই। কারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা পুরোপুরি আলাদা বিষয়।
বিল অনুযায়ী, সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য একজন ‘নিবন্ধক’ নিয়োগ দেবে এবং নিবন্ধকের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশন তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাবে। এ জন্য নিবন্ধকের কার্যালয়ের অধীনে একটি সেল থাকবে। এই সেলে নির্বাচন কমিশনের এক বা একাধিক কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন।
কিন্তু এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করা হলো না কেন? ইসির আইনসংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জানামতে, এই আইনের খসড়া প্রণয়ন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাঁদের কোনো আলোচনা হয়নি।
উল্লেখ্য, ৪ সেপ্টেম্বর সংসদে বিলটি উত্থাপনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, এখন যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করবে, জন্মের দিন থেকেই একটি পরিচয়পত্রের নম্বর তার হয়ে যাবে। ভোটার তালিকার ক্ষেত্রে এই আইন কোনো বাধা হবে না। যখন নাগরিকের বয়স ১৮ বছর হয়ে যাবে, তখনই তিনি ভোটার হয়ে গেছেন বলে নোটিশ পেয়ে যাবেন। তাঁর নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
মনে রাখা প্রয়োজন, জাতীয় পরিচয়পত্রযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে, যার পুরো দায়িত্বই পালন করেছে নির্বাচন কমিশন। পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা এক নয়—এই যুক্তিতে পরিচয়পত্রের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ে গেলেও তারা ভোটার তালিকা করতে কিংবা নির্বাচন কমিশনকে উপেক্ষা করতে পারে না। আইন করার আগে অবশ্যই ইসির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
নির্বাচনের তিন মাস আগে তড়িঘড়ি করে আইনটি পাস করার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর মাধ্যমে সরকার স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাই খর্ব করেনি, তারা এই প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থায় গিয়ে কাজ করেন, তাহলে কমিশনের স্বাধীনতা কতটুকু থাকবে?
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে গেলে ইসির পক্ষে ভোটার তালিকা তৈরি করা সম্ভব না-ও হতে পারে। অথচ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনকে একটি নির্ভুল তালিকা করতেই হবে।