রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতেই হবে

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়া কিংবা উন্নয়নের সুফল বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে না পারার সবচেয়ে বড় কারণ দুর্নীতি। সরকার ও রাজনৈতিক পরিসরকে ব্যবহার করে দুর্নীতি এতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বছরের পর বছর ধরে নিচের দিক থেকে ওপরের স্তরেই থেকে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারণা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কিছুটা ওপরে ছিল। এর সিংহভাগ দায় অবশ্যই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ১৫ মাস পর এসেও দুর্নীতি, দখল, চাঁদাবাজি অব্যাহত থাকাটা যারপরনাই উদ্বেগজনক।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ইশতেহার প্রণয়নে টিআইবির সুপারিশ–সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে গত রোববার সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দুর্নীতি অব্যাহত আছে বলে মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক ও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন মহল দলবাজি, দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সরকারের অভ্যন্তরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে।

বিগত সরকার যে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, তার মূল ভিত্তিই ছিল রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর শীর্ষ কর্তাব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীতন্ত্র। অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন থেকেই জানা যাচ্ছে, এসব গোষ্ঠী সাড়ে ১৫ বছরে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে ভাটা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির জোয়াল, বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার মান পড়ে যাওয়ার পেছনে অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতির সবচেয়ে বড় দায় রয়েছে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই নাগরিকদের প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো দখলদারি ও চাঁদাবাজি থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটাই ঘটেনি। বিগত সরকারের আমলের তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দুর্নীতির তুলনামূলক চিত্র পাওয়া না গেলেও দুর্নীতি দমনে অন্তর্বর্তী সরকার যে বড়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে, সম্প্রতি প্রথম আলোর জরিপে তা স্পষ্ট করে উঠে এসেছে। জরিপে ৭৫ শতাংশই মনে করেন, দুর্নীতি দমনে সরকার সফল হয়নি।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশের সমাজে দুর্নীতির যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গেড়ে বসেছে, সেখান থেকে এক দিনেই মুক্তি সম্ভব নয়। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জোরালো রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সংস্কারের উদ্যোগের ঘাটতি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারেও কমিশন করেছিল। সেই কমিশন গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু সুপারিশমালা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে নাগরিকেরা এখনো সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন। রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি, দখলবাজির কারণে নাগরিকদের বাড়তি দামে জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে। সরকারের অভ্যন্তরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তা তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার অনুসরণীয় কোনো দৃষ্টান্তও দেখা যায়নি।

আমরা মনে করি, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের যে সুযোগ এসেছে, সেটা কাজে লাগাতে হলে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই দুর্নীতি দমনের জোরালো অঙ্গীকার থাকতে হবে। রাজনৈতিক ও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ না করলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ অধরাই থেকে যাবে।