বিদ্যুৎ খাতের কর্তাব্যক্তিদের জবাব কী

সম্পাদকীয়

এ বছরের মার্চ মাসে সাড়ম্বরে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। চার মাস না যেতেই জুলাইয়ে এক ঘণ্টা করে ‘পরিকল্পিত’ লোডশেডিং করার ঘোষণা আসে। যদিও বাস্তবে লোডশেডিং হয়েছে আরও বেশি। সে সময় বলা হয়েছিল লোডশেডিংটা সাময়িক, অক্টোবর থেকে আর থাকবে না। কিন্তু অক্টোবর মাসে এসে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, উল্টো কোথাও কোথাও তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, জ্বালানিসংকটের কারণে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে অলস পড়ে থাকছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই গুনতে হচ্ছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত যেখানে দিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে, এখন তা বেড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত হয়েছে।

গত তিন মাসের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকায় তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। আর রাজধানীর বাইরে অনেক এলাকায় ৭ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনভোগান্তি তো বাড়ছেই, শিল্পকারখানার উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

লোডশেডিং যখন সহনীয় পর্যায়ে আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল, সে সময়ে উল্টো তা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি কেন এতটা খারাপ হলো, কবে এ থেকে মুক্তি মিলবে, তা নিয়ে সরকার এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট ও স্বচ্ছ কোনো বক্তব্য নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লোডশেডিং কমার জন্য প্রকৃতির ওপর তাঁরা ভরসা করে বসে আছেন। কবে শীত আসবে, কবে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে, সেই অপেক্ষা করছেন।

জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে বিদ্যুতের চাহিদা এমনিতেই কমে আসে। ফলে নভেম্বর মাস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সবচেয়ে শঙ্কার যে প্রশ্নটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে গরমের মৌসুম শুরু হলে লোডশেডিং পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

করোনা মহামারি–পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কারণে দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। আবার রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামও অনেকটা চড়ে ছিল। এসব কারণে ডলার–সংকট তৈরি হওয়ায় চাহিদামতো ডিজেল, গ্যাস, ফার্নেস তেল, কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি খাতে সরকারের অদূরদর্শী নীতি ও ভুল পরিকল্পনা আজকের এ সংকটের পেছনে দায়ী। এ বিষয়ে তাঁরা বহু বছর ধরে যুক্তি-তথ্য উপস্থাপন করে এলেও তাতে কর্ণপাত করেনি সরকার। নিজস্ব উৎস থেকে জ্বালানির সংস্থান না বাড়িয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে চলার সহজ কৌশলে চলেছে। ফলে দেশে একদিকে চাহিদার চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের করার মতো সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ আমদানিও করা হচ্ছে।

জ্বালানি খাতে অতি আমদানিনির্ভরতা দেশের জ্বালানিনিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় এ খাতের দুর্বলতা ও নাজুকতা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সম্প্রতি দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক মন্দার যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট করে বলা যায়, লোডশেডিংয়ের এ সংকট মোটেই সাময়িক নয়।

আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আত্মনির্ভর টেকসই জ্বালানি নীতি প্রণয়নের পথ ধরার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কি আদৌ সেভাবে ভাবছে? আর এখন সেভাবে ভাবতে শুরু করলেও সেই পথ তো দীর্ঘ। বোঝা যাচ্ছে দুর্ভোগ থেকে আপাতত মুক্তি নেই। সরকারের ভুল নীতির খেসারত কেন জনগণ দেবে? বিদ্যুৎ খাতের কর্তাব্যক্তিরা এর জবাব দেবেন কি?