ব্যর্থতা ও জনদুর্ভোগের দায় কারও নেই?

সম্পাদকীয়

যে প্রকল্পের কাজ চার বছরে শেষ হওয়ার কথা, সেই প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায় রাষ্ট্রের অপচয় ও জনগণের ভোগান্তি কত বেশি হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পথে বিআরটি হচ্ছে। কোথাও উড়ালপথে, কোথাও বিদ্যমান সড়কে চলাচল করার কথা বিশেষ বাস।

২০১২ সালে গৃহীত এ প্রকল্প ২০১৬ সালে চালুর কথা ছিল। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, বিআরটি চালু হলে ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। যানজট, সিগন্যাল কিংবা অন্য কোনো বাধায় বাস আটকে থাকবে না। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৮১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১০৯ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ২ হাজার ২২৫ কোটি।

কেন এ সময়ক্ষেপণ? কেন এ অর্থের অপচয়? আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তার কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নাধীন। উদ্বেগের বিষয় হলো এর বেশির ভাগই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। আর সময়ের সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে চলেছে।

বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি ও বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের যুগে একটি বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এত দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি অস্বাভাবিক। কিন্তু সেই অস্বাভাবিক কাজটি যাঁরা করলেন, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। পুরো বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।
মো. হাদিউজ্জামান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ

বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজের শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ যানজটে ভুগছে। বৃষ্টি হলে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত স্থানে স্থানে হাঁটুপানি জমে যায়। অন্য সময়েও সড়কের খানাখন্দ ও নির্মাণকাজের কারণে সড়কে যান চলাচল করছে ধীরগতিতে। অনেক সময় এক ঘণ্টার যাত্রা শেষ হতে পাঁচ-সাত ঘণ্টা লেগে যায়। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে মাঝেমধ্যে ওই সড়কে যানবাহন না চলার জন্য পুলিশকে গণবিজ্ঞপ্তিও দিতে হয়। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পর গত কয়েক দিনে জনভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও এ প্রকল্পকে গলার কাঁটা বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু গলার কাঁটা কারা তৈরি করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। প্রকল্পের কাজে নানা অনিয়ম অব্যবস্থা ও আর্থিক অপচয় সত্ত্বেও কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নির্মাণকাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ছয়জনের প্রাণ গেছে।

সর্বশেষ বিমানবন্দর সড়কে গত ১৫ আগস্ট গার্ডার চাপায় একই পরিবারের পাঁচজন মারা যান। প্রকল্পের ঋণদাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত না করে আবার কাজ শুরু করা যাবে না। এর পর থেকে ভারী কাজ বন্ধ আছে। হালকা কাজ চলছে। সে ক্ষেত্রে আগামী মার্চ নাগাদ এটি চালু করা যাবে কি না, সে বিষয়েও সংশয় আছে।

উত্তরায় গার্ডার ভেঙে যে পাঁচজন মানুষ মারা গেলেন, তার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায়ী বলে নিজেদের দায় এড়িয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। প্রকল্পের কাজের শেষ পর্যায়ে এসে প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের জন্য যে ক্রেন আনা হয়েছে, তার সক্ষমতা কম। আগে থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সজাগ থাকলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেছেন, বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি ও বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের যুগে একটি বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এত দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি অস্বাভাবিক। কিন্তু সেই অস্বাভাবিক কাজটি যাঁরা করলেন, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। পুরো বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।