গত রোববার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে মোটরযানের গতিসীমা-সংক্রান্ত যে নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে, তা দৃশ্যত ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
নির্দেশনা অনুযায়ী, মোটর কার, জিপ, মাইক্রোবাস, হালকা যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাস ও ভারী যাত্রীবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিসীমা এক্সপ্রেসওয়েতে ৮০ কিলোমিটার, জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি-এ) ৮০ কিলোমিটার, জাতীয় (ক্যাটাগরি-বি) ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৭০ কিলোমিটার, জেলা সড়কে ৬০ কিলোমিটার, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা সদরে ৪০ কিলোমিটার; উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে ৪০ কিলোমিটার; শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে ৩০ কিলোমিটার হবে। আর এক্সপ্রেসওয়েতে সর্বোচ্চ ৬০ ও মহাসড়কে সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালানো যাবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়কের এই নির্দেশনা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে রোড সেফটি কোয়ালিশন নির্দেশনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা এর যৌক্তিকতা ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সড়ক বিভাগ থেকে এ রকম নির্দেশনা অতীতেও দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে চলেছে, কারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে, সেসব সড়ক বিভাগের অজানা নয়। ২০১৮ সালের সড়ক আইনটি সংশোধন করে এমন অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীরাই উৎসাহিত হবে।
দেশে যখন এক্সপ্রেসওয়েসহ আধুনিক সড়কগুলো নির্মাণ করা হয়, তখন দ্রুতগতিরই দোহাই দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য দ্রুতগতির সড়ক পরিবহনব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, যদি যানবাহনের গতি কমিয়েই রাখা হবে, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে আমরা দ্রুতগতির সড়ক নির্মাণ করলাম কেন?
সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না। অস্বীকার করছি না সড়কের পাশে এ-সংক্রান্ত ফলক টানিয়ে দেওয়ারও। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও করতে হবে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকার কেন সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা আধুনিক করতে পারল না? অনেক দেশেই ডিজিটাল সংকেত থাকে এবং যানবাহনের সংখ্যার ভিত্তিতে গতিসীমাও বাড়ানো-কমানো হয়। আমাদের এখানে ঝড়ঝঞ্ঝা, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় অভিন্ন গতিসীমা নির্ধারিত থাকে।
দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়কে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ জন্য সড়ক বিভাগকে যেসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, তা হলো চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাঁদের দিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ না করানো এবং মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার রাখা, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যান সড়কে নামা বন্ধ করা। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে কিংবা নবায়ন করতে চালকদের হয়রানির শিকার হতে হবে না, এই নিশ্চয়তাও তাঁদের দিতে হবে।
বেপরোয়া যানবাহন চালনা রোধে গতিসীমা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেটা হতে হবে বাস্তবানুগ। কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবে, বেপরোয়া গতিই সড়কের একমাত্র সমস্যা নয়। অন্যান্য সমস্যা জিইয়ে রেখে গতিসীমার নির্দেশনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে না। বরং গতি নিয়ন্ত্রণের নামে একশ্রেণির পুলিশের চাঁদাবাজি এবং চালক-যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।