জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে সব মানুষের জন্য শিল্প–সংস্কৃতির প্রবাহ তৈরি করে শিল্প-সংস্কৃতিঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠন কাগজে-কলমে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির লক্ষ্য। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাস্তবে শিল্পকলা একাডেমি হয়ে উঠেছিল অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সাবেক মহাপরিচালকের স্বেচ্ছাচারিতা ও সরকারের গুণকীর্তনের প্রতিষ্ঠান। সংস্কৃতিকে ক্ষমতার কেরানিগিরি করা হলে একটি প্রতিষ্ঠান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তার ধ্রুপদি উদাহরণ হয়ে উঠেছিল প্রতিষ্ঠানটি।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে চাপা পড়ে গিয়েছিল শিল্পকলার দুর্নীতি। এ সময়ে শিল্পকলার বাজেট বেড়েছে ১০ গুণ। বাজেটের অঙ্ক যত বেড়েছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাত্রা তত বেড়েছে। শিল্পকলার বর্তমান বাজেট এখন ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু জনগণের করের সেই অর্থ জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে কতটা ব্যয় হয়েছে, আর কতটা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা কিছু মানুষের সুযোগ-সুবিধার কাজে ব্যয় হয়েছে, সেটা মূল প্রশ্ন।
কেননা দেশজুড়ে শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তারা পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ হলো স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চার বদলে ক্ষমতাসীন সরকারের মুখপত্র হিসেবে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর দেশের বিভিন্ন জেলায় ১২০টি যাত্রাপালা আয়োজন করে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি নিয়ে দুটি যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয় ৩২ বার। গবেষণার জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকলেও তার ব্যয় নিয়ে আছে প্রশ্ন। গত ১৪ বছরে সাবেক মহাপরিচালকের নামে বই প্রকাশ হয়েছে ২৫টি।
লিয়াকত আলী লাকী নজিরবিহীনভাবে টানা ১৩ বছর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। শিল্পকলার দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বহু ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম সমার্থক হয়ে উঠেছিল। তাঁর সময়ে ২২৭ কোটি টাকা গরমিল ধরা পড়লেও তার জবাব দেওয়া হয়নি। লাকীর বিরুদ্ধে কস্টিউম খরচ, অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন, বিদেশ সফর, শিল্পকর্ম কেনা, ভুয়া ভাউচার জমা নিয়ে কেলেঙ্কারির শেষ নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও স্বজনপ্রীতি নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ।
একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠার পরও কোনো মহাপরিচালক পদে লিয়াকত আলী লাকীর মেয়াদ বারবার করে বাড়ানো হয়েছে। তার সময়কার অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়োগ–বাণিজ্যের তদন্ত করতে হবে। তাঁকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দেওয়া ও সহযোগিতা করা সবাইকেই সেই তদন্ত ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
শিল্পকলা একাডেমিকে ক্ষমতার এই কেরানিগিরি থেকে বের করে আনা জরুরি। শিল্পকলা একাডেমি যেন শিল্পী, নাট্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীদের বহুমতের সংস্কৃতিচর্চা ও মিথস্ক্রিয়ার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। শিল্পকলা একাডেমি যেন প্রকৃত অর্থে দেশের সংস্কৃতিচর্চায় পথ দেখাতে পারে।