মূল্যস্ফীতি কমাতে শক্ত পদক্ষেপ দরকার

খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলেছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের কিছু মানুষ দ্রুত ধনবান হলেও বৃহৎ অংশ দরিদ্র ও স্বল্প উপার্জনকারী ব্যক্তিদের কাতারেই রয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, এর প্রতিকারে সরকারের পক্ষ থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং তা কতটা কার্যকর হয়েছে? 

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হারের ভিত্তিতে যে চারটি শ্রেণিতে দেশগুলোকে ভাগ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ ‘লাল’ শ্রেণিতে পড়ে। ৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি হলে সেটি এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আর মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে হলে সেটি ‘হলুদ’ ও ২ শতাংশের কম হলে ‘সবুজ’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে ৩০ শতাংশের বেশি হলে সেটি ‘বেগুনি’ শ্রেণিভুক্ত। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, খাদ্যের বাড়তি দাম বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

করোনা মহামারির আগপর্যন্ত বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কমবেশি ৫ শতাংশের মধ্যে ছিল। অর্থাৎ আমরা হলুদ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। দুই বছর ধরে পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, বর্তমানে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে। এর অর্থ, এক বছর আগে যে খাদ্যসামগ্রী মানুষ ১০০ টাকায় কিনেছে, এখন সেটি কিনতে তাদেরকে ১১২ টাকা ৬০ পয়সা গুনতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে বাড়তি ব্যয় করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে তারা হয় ধারকর্জ করে, অথবা অন্য খাতে ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।

পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজার পণ্য বিক্রি কিংবা এক কোটি পরিবারকে চাল, ডাল, তেলসহ কয়েকটি পণ্য সাশ্রয়ী দামে বিতরণ করে খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না। আবার ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে টিসিবি যে নীতি নিয়েছে, তাতে স্বল্প আয়ের মানুষেরা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত ২৪ দিনে রাজধানীর মোট ১৭২টি স্থানে গেছে টিসিবির ট্রাক। এর মধ্যে মতিঝিল ব্যাংকপাড়া ও সচিবালয়-সংলগ্ন এলাকায় গেছে সর্বোচ্চসংখ্যক দিন। 

উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া অন্য সব দেশের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে কম। ভারত, নেপাল ও ভুটানে মূল্যস্ফীতি যথাক্রমে ৮, ৮ দশমিক ৪ ও ৫ দশমিক ২ শতাংশ। পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ। আর শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এক বছর আগেও শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি ছিল। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও ঘটেছিল। এক বছরের ব্যবধানে তারা মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশ কেন পারল না? শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি কমার কারণ জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যপণ্যের দাম কমে যাওয়া।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২১ দশমিক ৯১ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় আছে, যার মধ্যে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, এমন মানুষের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। রংপুর বিভাগে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের হার ২৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। 

বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বৈশ্বিক কারণ দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে খাদ্যপণ্যের দাম কতটা বেড়েছে, আর দেশি বাজারে কতটা বাড়ানো হয়েছে, সেটা পরখ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও কথিত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যই দায়ী। মন্ত্রীরা সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করলেও তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারা দুঃখজনক। 

মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি টিসিবির মাধ্যমে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে, আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার অধীন নিয়ে আসতে হবে।