নাগরিক মৃত্যুর এই দুষ্টচক্রের অবসান কবে

সম্পাদকীয়

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলাগুলোয় পাহাড়ধস ও প্রাণহানি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হলেও এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসন দায়সারাভাবেই দায় এড়িয়ে চলার নজির স্থাপন করে চলেছে। কেবল বড় দুর্ঘটনায় অনেকের যখন প্রাণহানি হয়, তখনই কেবল সবাই খানিকটা নড়েচড়ে বসে।

পাহাড়ধসের কারণ কী এবং ফি বছরের এই ট্র্যাজিক হতাহত থেকে নাগরিকের জানমালের সুরক্ষা এবং পাহাড়ের প্রাণপ্রকৃতিকে বাঁচানোর পথ কী, সেটা সবারই জানা। কেননা ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিসহ আরও কয়েকটি ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কয়েক ডজন সুপারিশ করেছিল। বাস্তবে তা কার্যকর হয়েছে সামান্যই। বরং দারিদ্র্য আর বৈষম্যকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে পাহাড় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পদ গড়ার সোপান। পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই গাছের শিকড় উপড়ে দিয়ে তারা মানুষের বসতি বসায়। ভারী বৃষ্টির চাপ বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়া মাটি আর বইতে পারে না। ধসে পড়ে পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো মানুষের বসতিতে।

পাহাড়ধসে মানবিক বিপর্যয় হলেও অতিবৃষ্টির সময় মাইকিং করে সতর্কতা আর মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযানেই সীমাবদ্ধ প্রশাসনের কার্যক্রম। অথচ পাহাড় ‘হত্যার’ সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না। ফলে যত দিন গড়াচ্ছে, পাহাড়ে অবৈধ বসতির সংখ্যা ততই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। ফলে নিশ্চিত দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঝুঁকিটাও তীব্র হচ্ছে। কিন্তু নাগরিকের নিরাপত্তার নিরিখে এটা যে একটা জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, সেই স্বীকৃতি কোথায়?

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, চট্টগ্রাম নগরে পাহাড়ে অবৈধ বসতির যে তালিকা জেলা প্রশাসন করেছে, বাস্তবের সঙ্গে তার দূরবর্তী যোগসূত্রও নেই। জেলা প্রশাসন বলছে, নগরীর ২৬টি পাহাড়ে ৭ হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। অথচ সিটি করপোরেশনই বলছে, শুধু মতিঝরনা ও বাটালি পাহাড়েই ১০ হাজার পরিবার বসবাস করছে। ফলে এটা বোধগম্য যে পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা পরিবারের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি।

এটা সত্যি যে দারিদ্র্য ও শহরমুখী মানুষের স্রোত কমানো না গেলে পাহাড়ে অবৈধ বসতি নির্মাণ ঠেকানো যাবে না। কিন্তু পাহাড় বাঁচাতে ও নাগরিকের প্রাণ বাঁচাতে তদন্ত কমিটিগুলো যেসব সুপারিশ করেছে, তার বাস্তবায়ন কে করবে? পাহাড়ে কতজন মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে বসবাস করছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান যদি প্রশাসন না করে, তাহলে সমস্যার গভীরতা কতটা, সেটা নিরূপণ হবে কীভাবে?

পাহাড়ধসে ফি বছর নাগরিক মৃত্যুর এই দুষ্টচক্রের অবসান অবশ্যই হতে হবে।