ইকোট্যুরিজমের নির্দেশিকা চাই সবার আগে

প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ সুন্দরবন বাংলাদেশের সত্যিকারের মহাপ্রাণ। অসংখ্য প্রাণের (বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী) আবাসভূমি সুন্দরবনের প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকের কৌতূহল থাকায় এখানে পর্যটনের সম্ভাবনাও অপার। সে ক্ষেত্রে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির যেন একচুলও ক্ষতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করেই নিতে হবে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের পরিকল্পনা।

বাস্তবে দেখা যায় উল্টো। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সুন্দরবনকেন্দ্রিক যে অল্প কিছু পর্যটনের বিকাশ হতে দেখছি, তার সিংহভাগের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের কথা চিন্তা করা হচ্ছে না। বরং আমরা দেখছি, পর্যটনের নামে লঞ্চ বা ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা অবাধে সুন্দরবনের খালগুলোয় প্রবেশ করছে। পানি ও পরিবেশদূষণের সঙ্গে শব্দদূষণও আকসার ঘটছে। নিয়ন্ত্রণহীন ও কাণ্ডজ্ঞানহীন এসব কর্মকাণ্ডের কারণে সুন্দরবনে ইরাবতী ডলফিনসহ বিশ্বের অনেক বিপন্নপ্রায় প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্তির মুখে পড়ছে।

এই প্রেক্ষাপটে সরকারি উদ্যোগে খুলনার দাকোপে কালাবগী ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র খানিকটা আশা জাগায়। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, খুলনা শহর থেকে সড়কপথে ৫০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের কালাবগী ফরেস্ট স্টেশনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রটি। গত বছরের ২০ অক্টোবর থেকে পর্যটকদের সেখানে ভ্রমণের অনুমতি দিতে শুরু করেছে বন বিভাগ।

পর্যটনকেন্দ্রটিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বানর, হরিণ, বন্য শূকর, কুমিরসহ কয়েক প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। হরিণ লালনপালনের সঙ্গে এটি হরিণের প্রজননকেন্দ্রও। এ ছাড়া গরান কাঠ দিয়ে ঘিরে রাখা ছোট ছোট পুকুরে আছে কুমির। সুন্দরবন দেখার জন্য সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। চারপাশে দেড় কিলোমিটারের মতো পাকা সড়ক তৈরি করা হয়েছে, যেখানে পর্যটকেরা হেঁটে হেঁটে সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পান। 

এর আগে আমরা দেখেছি, বাগেরহাটের করমজলে কুমির প্রজননকেন্দ্র ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেখানকার কর্মীদের নানা অনিয়মের খবর প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসছে। কালাবগী ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের ক্ষেত্রে তেমনটা যেন না ঘটে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।

ইকোট্যুরিজম ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় অভিধানে ইকোট্যুরিজমের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হচ্ছে যে পরিবেশের ক্ষতি না করে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তা হয় এমন পর্যটন। ইদানীং চারপাশে ইকোট্যুরিজম শব্দটি দেদার শোনা গেলেও সেখানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাও দেখা যায় না। ২০১০ সালে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় যে নীতিমালা করেছে, সেখানে ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন, বিপণন কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে টাস্কফোর্স গঠনের কথা বললেও ইকোট্যুরিজমের সংজ্ঞায়ন কিংবা সেটা কীভাবে হবে, তার গাইডলাইন বা নির্দেশিকা নেই।

সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনা এগিয়ে নিতে হলে ইকোট্যুরিজমের বিকল্প নেই। কিন্তু সবার আগে ইকোট্যুরিজমের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ ও নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে হবে।