বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ তৈরি করুন 

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুবর্ণ সুযোগ আছে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যতই প্রচার চালান না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন। সম্প্রতি জাপানের বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক সংস্থা জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, এমন ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ জাপানি কোম্পানি এখানে ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। ২১৪টি জাপানি কোম্পানির ওপর জরিপ চালানো হয়।

বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ৩২৪। তার মধ্যে কিছু বন্ধ আছে বর্তমানে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে প্রায় ৪৬ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। ডলারের বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, দেশীয় মুদ্রায় জাপানি এ বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা।

জেট্রোর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশে সন্তুষ্ট নয় ৭১ শতাংশ কোম্পানির মধ্যে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ একেবারে অসন্তুষ্ট। আর ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ বলেছে, তারা ‘কিছুটা অসন্তুষ্ট’। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আসিয়ান ও উত্তর-পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণের দিক থেকে জাপানের কোম্পানিগুলোর কাছে প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৭২ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বলেছে, তারা বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায়। জাপানিদের আগ্রহের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াও বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে।

বাংলাদেশে ব্যবসার আগ্রহের কারণ হিসেবে তারা এখানকার সস্তা শ্রম, শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজ প্রাপ্তি, বিশেষায়িত জনশক্তি ও প্রকৌশলীর সহজলভ্যতা এবং বিদ্যমান বাজারব্যবস্থার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গতিশীল হওয়ায় বাজারের আকার ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে।

তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে জাপানি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তার মধ্যে আছে ব্যবসার অনুমোদন ও সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ও করব্যবস্থার অদক্ষতা। প্রায় ৮০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি মনে করে, এ দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় বাধা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আর ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশ জাপানি কোম্পানির মতে, করব্যবস্থার অদক্ষতা ব্যবসার ক্ষেত্রে এ দেশে বড় বাধা। এ ছাড়া বিদেশি মূলধনের আইনি কাঠামো বা ভিত্তি তৈরি এবং বিদেশিদের ভিসা ও কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) প্রাপ্তির জটিলতারও সম্মুখীন হতে হয় তাদের। ২০২২ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে জাপানিদের শুল্ক ছাড়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগত সমস্যা ও বৈদেশিক মুদ্রার দামের অস্থিরতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, সেটা হয়তো সাময়িক।

বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় উৎসাহের প্রধান কারণ, এখানে উৎপাদন খরচ কম। প্রশ্ন হলো এত সুবিধা থাকতেও সরকার কেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট করতে পারছে না? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দেশেই যান, সেই দেশের ব্যবসায়ীদের আরও বেশি মাত্রায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু সেই আহ্বানে কতজন সাড়া দিয়েছেন, সেটাও দেখার বিষয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা আমরা বহু বছর ধরেই শুনে আসছি। সমাধান হচ্ছে না কেন? সরকার বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করল, তার কয়টি চালু করা গেছে? জাপানি বিনিয়োগকারীরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীরাও কমবেশি তার ভুক্তভোগী। শুধু বক্তৃতা দিলে তো বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নতি হবে না। বিনিয়োগ–সহায়ক পরিবেশও তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ও অবকাঠামোগত যেসব সমস্যা আছে, তার সমাধানে সরকার সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশিত।