উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগে কার্পণ্য কেন

সম্পাদকীয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় ধারাবাহিকভাবে কমছে; যা এখন মাত্র ৭০২ টাকা। মাসে দাঁড়ায় ৫৮ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয়সহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য নিয়ে করা হয়েছে প্রতিবেদনটি।

ইউজিসির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে (এক বছর) একেকজন শিক্ষার্থীর জন্য গড়ে ব্যয় করেছে ১ হাজার ১৫১ টাকা; যা পরের বছর কমে করা হয় ৭৪৩ টাকা। আর ২০২২ সালে গড়ে একেকজন শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ৭০২ টাকা। অর্থাৎ মাসে ৫৮ টাকার সামান্য বেশি।

দেশে উচ্চশিক্ষায় যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন, তার মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশই পড়েন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ আছে ২ হাজার ২৫৭টি। এসব কলেজে মোট শিক্ষার্থী ৩১ লাখ ৭২ হাজারের বেশি। তবে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর পড়াশোনার মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন আছে। ঠিকমতো ক্লাস না করে পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগ আছে।

বর্তমানে দেশে অনুমোদিত পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৬৯টি। এর মধ্যে ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টি। তবে শিক্ষার্থীপিছু তুলনামূলক ব্যয়ের তথ্যটি ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।

ইউজিসির তথ্য বলছে, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় সব সময়ই বেশি। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক কিছু গবেষণাগারে কিংবা হাতে–কলমে শিক্ষা দিতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও তুলনামূলক কম থাকে। শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় বেশি করে, সেগুলোর পড়াশোনা ও গবেষণার মান তুলনামূলকভাবে ভালো। আর যারা কম ব্যয় করে, তাদের শিক্ষার মান খারাপ হবে—এটাই স্বাভাবিক।

বর্তমান বাজারে বছরে ৭০২ টাকা একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের বিনিয়োগ হাস্যকরই মনে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই শিক্ষায় বরাদ্দের হার সবচেয়ে কম।

তবে ইউজিসির হিসাবে শুভংকরের ফাঁকি আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান প্রশ্ন তুলেছেন, ওই হিসাবের সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন ও শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে কি না। যদি সেটা না হয়ে থাকে, সেই দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এড়াতে পারেন না। ইউজিসি বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শাক দিয়ে যতই মাছ ঢাকতে চান না কেন, তাঁকে স্বীকার করতেই হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বাদ দিলেও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলেও ধারেকাছে আসে না।

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের ব্যয়ের একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীর পেছনে ৩ লাখ টাকা আর কোনো শিক্ষার্থীর পেছনে ৭০০ টাকা—এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে হবে না। আমাদের সমাজে আরও অনেক ক্ষেত্রে প্রকট বৈষম্য আছে। কিন্তু শিক্ষার বৈষম্যটি সবচেয়ে পীড়াদায়ক ও ক্ষতিকারক।

উচ্চশিক্ষার বেহাল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে শিক্ষার অভিভাবকদের নতুন করে ভাবতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো নিয়ে বারবার পরীক্ষা–নিরীক্ষা বাদ দিয়ে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিন। মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ান।