বহুজাতিক টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান টেলিনরের ‘ডিজিটাল লাইভস ডিকোডেড’ শীর্ষক সমীক্ষায় যেসব চিত্র উঠে এসেছে, তাতে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই-ই আছে। ইতিবাচক দিক হলো, ৯১ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহারকারীর জীবনমানের উন্নতি হওয়া। একটি মুঠোফোন মানুষের জীবনকে কতটা বদলে দিতে পারে, এ তথ্য তারই প্রমাণ। আগে বেশির ভাগ নারী ঘরে থাকতেন বলে উপার্জনের চিন্তা করতেন না। এখন হাতের কাছে মোবাইল থাকায় তাঁরা ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারেন। এ কারণেই মুঠোফোন নারীর জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। পরিবর্তন এনেছে পুরুষের জীবনেও, তুলনামূলক কম।
বাংলাদেশসহ আটটি দেশের আট হাজার মুঠোফোন ব্যবহারকারীর ওপর পাঁচটি প্রভাবের কথা এসেছে, যার মধ্যে আছে জীবনমানের উন্নয়ন, মুঠোফোন ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে না পারা। টেলিনরের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৬৭ শতাংশ নারী ও ৬২ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, শিক্ষার সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে মুঠোফোন প্রযুক্তির অবদান আছে। মুঠোফোন-সংযোগ পুরুষদের তুলনায় নারীদের কর্মসংস্থান ও উপার্জনের বিকল্প পথ তৈরি করেছে। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই নারী এগিয়ে।
এসব ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও সমীক্ষার উদ্বেগজনক তথ্য হলো, মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের ৯৭ শতাংশই গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রার যেমন মান বাড়িয়েছে, তেমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও ঠেলে দিয়েছে। এ উদ্বেগ সব প্রজন্মের মানুষের জন্য সমান নয়। যাঁদের বয়স অপেক্ষাকৃত বেশি, তাঁরাই গোপনীয়তা নিয়ে বেশি চিন্তিত। বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বেবি বুমার্স প্রজন্মের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত যাঁদের জন্ম) ৮৯ শতাংশ। এ ছাড়া জেনারেশন এক্সের (সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশক পর্যন্ত যাঁদের জন্ম) ৭৮ শতাংশ, মিলেনিয়ামের (আশির পর থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি যাঁদের জন্ম) ৭৪ শতাংশ এবং জেনারেশন জেডের (১৯৯৫ সালের পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যাঁদের জন্ম) ৭০ শতাংশ।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত সব তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে সংরক্ষিত থাকে। দুই কারণে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। প্রথমত, প্রতিষ্ঠান যদি তৃতীয় কারও কাছে সেই তথ্য দিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠান নিজেও তার স্বার্থে সেই তথ্য ব্যবহার করে থাকে। অনেক সময় সরকারি সংস্থাও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মুঠোফোন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নেয় বলে অভিযোগ আছে। দুই ক্ষেত্রেই গ্রাহকেরা হয়রানির শিকার হন। এখানে সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার যে চুক্তি, তা কোনো পক্ষ ভঙ্গ করতে পারে না। করলে সেটি আইনের চোখে দণ্ডনীয়।
অনেক মুঠোফোন গ্রাহক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার যে অভিযোগ করেছেন, তার প্রতিকার হলো এ সম্পর্কে তাঁদের প্রশিক্ষিত করে তোলা। গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ইয়াসির আজমান সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও সাইবার সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
বিষয়গুলো সরকার গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে পারে। যেই সাইবার নিরাপত্তা প্রায় প্রতিটি মানুষে জীবনে অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে, সেই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। আর মুঠোফোন ব্যবহারকারীর বড় একটি অংশ গ্রামে, ফলে সেখানে সাইবার সচেতনতা গড়ে তোলাও আমরা জরুরি মনে করি।
সর্বোপরি প্রত্যেক মুঠোফোন গ্রহীতাকে তথ্যগত সুরক্ষা দিতে হবে। আদালতের নির্দেশ ছাড়া সরকারও সেই তথ্য ব্যবহার করতে পারে না।