উৎপাদক ও ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষিত হোক

সম্পাদকীয়

বোরো মৌসুমে এবার চালের উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশে ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৫০ হাজার হেক্টর বেশি। এতে চাল উৎপাদন ৫ লাখ টন বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। তবে বোরোর বর্ধিত উৎপাদন দেখেই পুরোপুরি আশ্বস্ত হওয়া যাবে না। আগামী আমন ও আউশের ফলনও মাথায় রাখতে হবে। সাধারণত আমন মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এবার চালের উৎপাদন ৪ কোটি টন ছাড়াবে, যা দেশের চাহিদার তুলনায় কমপক্ষে ৪০ লাখ টন বেশি। ফলে চাল আমদানির দরকার নেই।

মো. শাহজাহান কবীরের এই আশ্বাসবাণী চালের দামের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অভয় দিতে পারবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। কেননা চালের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি এর চাহিদাও বেড়েছে। অন্যদিকে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়ও। বোরো মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে না পারায় কৃষককে বেশি দামে জ্বালানি কিনে সেচ দিতে হয়েছে।

চালসহ কৃষিপণ্যের দামের ওঠানামা নির্ভর করে সাধারণত উৎপাদন ব্যয় ও সরবরাহব্যবস্থার ওপর। অস্বীকার করার উপায় নেই কৃষি খাতে সরকারের ভর্তুকির সুফল দেশবাসী পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা সত্ত্বেও বাংলাদেশ খাদ্যশস্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে সরকারের সহায়ক নীতির অন্যতম দুর্বলতা হলো ধান–চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া। চলতি বছরও সরকার বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে ৫ লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধানের পাশাপাশি ৪৫ টাকা কেজি দরে ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল ও এক লাখ টন আতপ চাল কেনার কথা বলা হয়েছে।

ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে কৃষক যেমন শস্যের ন্যায্য দাম পাবেন, তেমনি খাদ্যনিরাপত্তা সংহত হবে। এর ব্যত্যয় হলে মিলমালিক, ফড়িয়া, দালালেরা লাভের গুড় হাতিয়ে নেবে। ধানের দাম কম হলে কৃষক বঞ্চিত হন আবার বেশি দাম হলে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা অনুযায়ী, অতি দরিদ্র মানুষ আয়ের ৩২ শতাংশ ও দরিদ্র মানুষ ২৯ শতাংশ ব্যয় করেন চাল কিনতে।

দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে ধান–চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা যেমন পূরণ করতে হবে, তেমনি বিকল্প উপায়ে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে; যাতে স্বল্প আয়ের মানুষ কম দামে চাল কিনতে পারেন। বর্তমানে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে যে চাল বিক্রি করা হয়, তার পরিমাণ এত কম যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশই এর বাইরে থেকে যায়।

বৈশ্বিক বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আবার ভারতসহ যেসব দেশ থেকে আমরা চাল আমদানি করি, তারাও অনেক সময় রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই। তবে সেটা তখনই সম্ভব হবে, যখন কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবেন।

ধান-চালের মজুত নিয়েও অনেক সময় হিসাবের গরমিল দেখা দেয়। একেক সংস্থা একেক হিসাব দিয়ে থাকে। এ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। মূল কথা হলো উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।