প্রার্থীদের সংঘাতে ভয় ছড়াচ্ছে জনমনে

সম্পাদকীয়

৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনটি প্রতিযোগিতামূলক না হলেও যথেষ্ট নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী এবং একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যকার বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকেরা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন, নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করছেন, ককটেল হামলা চালাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে নওগাঁর রানীনগরে। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর স্ত্রী ও সমর্থকেরা নির্বাচনী প্রচারে গেলে নৌকার সমর্থকেরা তাঁদের অবরুদ্ধ করে রাখেন।

পরে দুই পক্ষে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রতিপক্ষের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে কুষ্টিয়া, গাজীপুর, ফরিদপুর, রংপুর, পটুয়াখালী, মেহেরপুর, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জসহ অনেক স্থানে। মানিকগঞ্জ-২ আসনের নৌকার প্রার্থীর এক সমর্থক নৌকায় ভোট না দিলে হাত কেটে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। অন্য একটি আসনে নৌকায় ভোট না দিলে সোজা করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন প্রার্থীর সমর্থক। আবার কয়েকটি স্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের হাতে নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

নির্বাচনী আচরণবিধি সম্পর্কে প্রার্থীদের এলেম দিতে নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীরা বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময় করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। আচরণবিধি না মানার কারণ, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রতি আসনে একজনকে নৌকা দেওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করছেন। ফলে তাঁরা মনে করছেন, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই ভোটের রাজত্বে।’

সাধারণত নির্বাচনে ভোটাররাই রাজা থাকেন। তাঁদের কাছে প্রার্থীরা ধরনা দেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে। সে ক্ষেত্রে এক দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচিকে খণ্ডন করা অপর দলের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো অংশ না নেওয়ায় সেই সুযোগ নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিরা তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছেন, এ নির্বাচনে বিরোধী দল কারা হবে? এর অর্থ হলো ভোটের আগেই মানুষ জেনে গেছে কারা সরকার গঠন করবেন।

বুধবার প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ঢাকা-৫ আসনের কোথায় কোথায় নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এতে দেখা যায়, আচরণবিধি উপেক্ষা করে প্রার্থীরা যত্রতত্র নির্বাচনী অফিস খুলে বসেছেন। কোথাও রাস্তা-ফুটপাত বন্ধ করেও সেটি করা হয়েছে। আবার বেলা দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মাইকিং করার সময় বেঁধে দেওয়া হলেও কোনো প্রার্থী তা মানছেন না। এ ঘটনা কেবল ঢাকা-৫ আসন নয়, যেখানেই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন, সেখানে কেউ নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না।

ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিরোধী দলের সন্ত্রাস–নাশকতা সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ করছেন। কিন্তু নিজ দলের যেসব নেতা–কর্মী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অব্যাহত সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। কেবল বিরোধী দলের কর্মসূচি নয়, ক্ষমতাসীন দলের ভোটযুদ্ধও মানুষের মধ্যে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনী মাঠে নামলে সংঘাত বন্ধ হবে। এর অর্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংঘাত বন্ধ করতে অপারগ? এর মানে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন না করা পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যকার সংঘাত–সংঘর্ষ চলতেই থাকবে?