অপচয়–দুর্নীতি বন্ধ না হলে লোকসান বাড়বেই

সম্পাদকীয়

একই দিনের দুটি খবর। রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম বলেছেন, ‘সারা দেশে রেলের ২৩ হাজার একরের বেশি জমি বেদখল হয়ে আছে। অনেকে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রেলের জমি ভোগদখল করছেন।’ অন্যটি হলো রেলওয়ের ভাড়া বাড়ানোসংক্রান্ত। বেশি দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রীদের রেয়াত (ছাড়) না দিয়ে বছরে ৩০০ কোটি টাকা আয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেলে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। পরবর্তী ১০১ থেকে ২২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ছাড় বা রেয়াত দেওয়া হয়। ২৫১ থেকে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ২৫ শতাংশ এবং এর বেশি দূরত্বের জন্য ৩০ শতাংশ ভাড়া ছাড় দেওয়া হয়।

বর্তমানে রেলের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ৩৯ পয়সা। এর সঙ্গে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) ও অন্যান্য উচ্চশ্রেণিতে বিভিন্ন হারে ভাড়া ও ভ্যাট যোগ হয়। রেলওয়ের কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, ভাড়ার নতুন হার কার্যকর হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত শোভন শ্রেণির ভাড়া বাড়বে ১২০ টাকার মতো। আর এসি কামরায় বার্থে বাড়বে ২১৬ টাকার মতো। তবে ঢাকা থেকে নরসিংদী, জয়দেবপুর, ফরিদপুর কিংবা ১০০ কিলোমিটারের নিচের দূরত্বে ভাড়া বাড়বে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, এর মাধ্যমে তাদের ৩০০ কোটি টাকা আয় বাড়বে।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এমন সময়ে দূরের যাত্রায় ভাড়া বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন নিত্যপণ্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল। এর ওপর ঈদের আগে ট্রেনে বাড়তি ভাড়ার চাপ তাঁদের আরও বিপদে ফেলবে। যাত্রীদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে রেলওয়ে ৩০০ কোটি টাকা আয় বাড়াতে চাইছে। কিন্তু সংস্থাটিতে যে অপচয় ও দুর্নীতি গেড়ে বসেছে, সেসব কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভাড়া বাড়ানো হলো রেলওয়ের কাছে সবচেয়ে সহজ সমাধান।

বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে বছরে দুই হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। যেখানে প্রতিবেশী ভারতে রেলওয়ে লাভজনক ও গণবান্ধব পরিবহনে পরিণত হয়েছে, সেখানে আমাদের রেলওয়ে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রেলওয়েকে নিরাপদ বাহন বলা হলেও প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অযত্নের কারণে। কয়েক বছর আগে রেলওয়ের টিকিট কালোবাজারির বিরুদ্ধে যাত্রীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন হয়েছিল। পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটেনি।

আওয়ামী লীগ সরকার রেলওয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় করার কৃতিত্ব দাবি করে। নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণের পাশাপাশি রেলের উন্নয়নে নানা প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু রেলওয়ের এত বিপুল সম্পদ থাকার পরও সরকার কেন সংস্থাটিকে স্বাবলম্বী করতে পারল না, সেই প্রশ্নের জবাব নেই। রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক মন্ত্রী কালো বিড়াল ধরতে গিয়ে নিজেই কালো বিড়ালের শিকার হয়েছিলেন। সেই কালো বিড়াল এখনো রেলওয়েতে দৌরাত্ম্য দেখাচ্ছে।

রেলমন্ত্রী ঢাকার রেলওয়ের জমি উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মার্কেট বন্ধ করার কথা বলেছেন। কিন্তু যে সংস্থাটি তাদের জমিতে মার্কেট নির্মাণ করল, তাদের বিরুদ্ধে তাঁরা আইনি পদক্ষেপ নিলেন না কেন? সারা দেশে রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বেহাত হয়েছে বলে মন্ত্রী যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে জনগণ আশ্বস্ত হবেন না। তাঁরা তখনই আশ্বস্ত হবেন, যখন দেখবেন বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।