বাণিজ্যিক স্থাপনা অগ্রহণযোগ্য

সম্পাদকীয়

সবুজ উদ্যানকে নগরজীবনের ফুসফুস হিসেবে গণ্য করা হয়। ফুসফুস ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, তেমনি নগরও বাঁচতে পারে না প্রয়োজনমতো সবুজ উদ্যান বা পার্ক ছাড়া।

দেড় কোটি জন-অধ্যুষিত ঢাকা শহরে সবুজ উদ্যান কিংবা উন্মুক্ত খোলা জায়গার পরিমাণ খুবই কম। আবার যেটুকু আছে, দখল-দূষণের শিকার হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডে পার্ক বা উদ্যান আছে মাত্র ২৭টি।

এর মধ্যে ৬টি পার্ক ইজারাদারের হাতে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটিতে পার্ক রয়েছে ২৩টি। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি পার্ক থাকার কথা।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, দেড় কোটি টাকা খরচ করে দুই বছর আগে পুরান ঢাকার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্ক সংস্কার করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তখন এটিকে খোলা জায়গা হিসেবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছিল। সেখানে এখন খাবারের দোকান ও গুদাম বানানো হয়েছে। পার্কের একাংশ দখল করে শিশু-কিশোরদের বিনোদনের নামে বসানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইড (ট্রেন, নাগরদোলাসহ খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম)।

বাহাদুর শাহ পার্কের সবুজ চত্বর রক্ষায় এক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে ইজারাদার স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করায় পার্কের প্রাণপ্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করছেন বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে ইজারা দেওয়ার কারণেই উদ্যানগুলোতে বাণিজ্যিক স্থাপনা বসানো হয়েছে। এই ধারা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে শহরে উন্মুক্ত জায়গা বলে কিছু থাকবে না।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে ২৩টি পার্ক রয়েছে। তারা কোনো পার্ক ইজারা দেয়নি। শুধু একটি পার্ক (গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্ক) পরিচালনার দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষকে দিয়েছে। পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান পার্কের ভেতরে কফি শপ চালু করা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, পার্কে বাণিজ্যিক স্থাপনা থাকলে শুধু পরিবেশ-প্রতিবেশই নষ্ট হয় না, সাধারণ মানুষও পার্কে অবাধ ও নিরিবিলি পরিবেশে সময় কাটানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

নগর-পরিকল্পনাবিদদের মতে, কোনো নগর এলাকায় তিন শ্রেণির পার্কের পরিকল্পনা করতে হয়—হাঁটা দূরত্বে নেইবারহুড বা পাড়াভিত্তিক পার্ক, কমিউনিটি পর্যায়ে কমিউনিটি বা মহল্লাভিত্তিক পার্ক এবং নগরের বৃহৎ পরিসরে সিটি বা নগর পার্ক। ঢাকা শহরের বিদ্যমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১০) অনুসারে, প্রতি সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য দুটি থেকে তিনটি খেলার মাঠ দরকার, যার প্রতিটির আয়তন হবে ন্যূনতম এক একর।

ঢাকা শহরে সীমিতসংখ্যক যে পার্ক কিংবা উন্মুক্ত জায়গা আছে, সেগুলো নানা অছিলায় দখল করে নেওয়া হচ্ছে। বছর দুই আগে কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠটি দখল করে কলাবাগান থানা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তবে স্থানীয় লোকজনের প্রতিবাদ ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সেই মাঠটি রক্ষা পেয়েছে।

এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ খেলার মাঠের পরিষেবা পেয়ে থাকে। বাকি ৮৪ শতাংশ খেলার সুযোগ-সুবিধার বাইরে আছেন। ঢাকা শহরে যেসব পার্ক ও উন্মুক্ত জায়গা দখল হয়ে আছে, সেগুলো উদ্ধার করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে দুই সিটি করপোরেশনকেই। সেখানে কোনো বাণিজ্যিক স্থাপনা করা যাবে না। পার্ক ও খোলা উদ্যানগুলোতে সবার অভিগম্যতা থাকতে হবে।