সরকার নিজের আইন নিজে লঙ্ঘন করছে

সম্পাদকীয়

দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরে যে গুটিকয় উন্মুক্ত স্থান আছে, তার মধ্যে ধানমন্ডি লেকটি উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশকে এটি ঝিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও পরবর্তী সময়ে লেকে রূপান্তরিত করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এর সৌন্দর্যবর্ধনে বিপুল অঙ্কের অর্থও ব্যয় করা হয়।

কিন্তু ধানমন্ডি লেকের সেই সৌন্দর্য কি এখন আছে? এককথায় এর উত্তর হলো নেই। এর জন্য কারা দায়ী? যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব লেকটি রক্ষার, তারাই সরকারদলীয় লোকদের একের পর এক রেস্তোরাঁ করার সুযোগ করে দিয়ে পরিবেশ নষ্ট করছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদক সরেজমিনে দেখতে পান, রেস্তোরাঁগুলোর কারণে সৃষ্ট ময়লা–আবর্জনায় লেকের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

এই বাণিজ্যিকীকরণের পেছনে সেখানে আসা মানুষের সুবিধার চেয়ে বেশি বিবেচিত হয়েছে ইজারার মাধ্যমে সরকারদলীয় নেতাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লেকের আইনকানুনেরও পরোয়া করেন না বলে অভিযোগ আছে।

লেকটিকে সাতটি সেক্টরে ভাগ করে ছয়টি সেক্টর আওয়ামী লীগ কিংবা এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে ইজারা দিয়েছে দক্ষিণ সিটি। সেই ছয় সেক্টরে চলছে ১৩টি রেস্তোরাঁ। ইজারার শর্ত অনুযায়ী, ফুড ভ্যান চালানোর কথা থাকলেও গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় রেস্তোরাঁ। এর জন্য কোনো ব্যবস্থাও নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন।

এ ছাড়া লেক ঘিরে একাধিক কিশোর বাহিনী গড়ে ওঠার খবরটিও উদ্বেগজনক। গত ২২ অক্টোবর রাতে লেকে খুন হন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শাহাদত হোসেন মজুমদার (৫১)। পুলিশ বলছে, এই খুনে জড়িত ছিনতাইকারীরা। একদিকে রেস্তোরাঁর কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের হাঁটাহাঁটি, অন্যদিকে ছিনতাইকারীদের কারণে তৈরি হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা।

ধানমন্ডি লেকের উন্নয়নকাজের নকশা করেছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। প্রথম আলোর কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, ধানমন্ডি লেকটিকে চরিত্র বদল করে বাণিজ্যিক স্থাপনায় পরিণত করা হয়েছে, যা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।

স্থানীয় কাউন্সিলর রফিকুল ইসলামও স্বীকার করেছেন, সিটি করপোরেশনের খামখেয়ালির কারণে ধানমন্ডি লেক ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সেখানে দলীয় লোকদের রেস্তোরাঁ ইজারা দেওয়ার কারণে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। চেয়ার বসানোর কথা ১০টি। তাঁরা বসিয়েছেন ২০০টি।

দক্ষিণ সিটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ধানমন্ডি লেকে ইজারার মাধ্যমে ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার কিছু বেশি আয় করেছে, যা করপোরেশনের মোট রাজস্বের (২০২১-২২) শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। এই সামান্য আর্থিক সুবিধার জন্য তারা ঐতিহ্যবাহী ধানমন্ডি লেকটির পরিবেশ বিপন্ন করতে পারে না। সিটি করপোরেশন যতই আত্মপক্ষ সমর্থন করুক না কেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না।

শুধু ধানমন্ডি লেক নয়, নগরের আরও কিছু উন্মুক্ত জায়গাকে ইজারার আওতায় আনছে দক্ষিণ সিটি। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে খাবারের দোকানের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। ইজারার শর্তে সেখানে তিন চাকার একটি ‘ফুড ভ্যান’ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে স্থায়ী অবকাঠামো করেছেন ঠিকাদার।

উন্মুক্ত এলাকা রক্ষায় ২০০০ সালে যে আইন আওয়ামী লীগ সরকার করেছে, সেই আইন তারা লঙ্ঘন করে চলেছে। ওই আইনে বলা হয়েছিল, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে বুঝতে হবে, লেককে ব্যবসাকেন্দ্র বানালে ধানমন্ডির সঙ্গে মতিঝিলের মধ্যে এখনো যে পার্থক্য আছে, তা-ও ঘুচে যাবে। আমরা আশা করব, লেকটির জন্য হুমকি তৈরি করে, এমন ইজারা দেওয়া থেকে সরে আসবে তারা। ইতিমধ্যে যাঁরা অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অবৈধ স্থাপনাগুলো কবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।