অনিশ্চয়তা কাটুক, গতি আসুক অর্থনীতিতে

সম্পাদকীয়

দায়িত্ব নেওয়ার ১০ মাসের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকারকে নতুন অর্থবছরের (২০২৫–২৬) বাজেট দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ে। বিগত সরকারের শেষ বছরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। গত কয়েক মাসে সেটা ৯ শতাংশে নেমে এলেও জনজীবনে উদ্বেগ থেকেই গেছে। সরকার বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার যে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলছে, তার সম্ভাবনা নিয়েও অর্থনীতিবিদেরা সংশয় প্রকাশ করেছেন।

মূল্যস্ফীতি না কমলে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাবে এবং তাঁদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনীতিকে মহাবিশৃঙ্খল অবস্থায় রেখে গিয়েছিল। বিশেষ করে একশ্রেণির লুটেরা ঋণের নামে ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। গত ১১ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকিং খাতে আংশিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে যে ধস নেমেছিল, তা–ও ঠেকানো গেছে সরকারের বাস্তবমুখী নীতি–পরিকল্পনায়। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা এসেছে।

এ সময়ে সরকার দুটি খাতে ভালো সাফল্য দেখিয়েছে—রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে। আগের অর্থবছরের চেয়ে বিগত অর্থবছরে (২০২৪–২৫) ২৭ শতাংশ বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমে যাওয়ার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে ১১ মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলেও রপ্তানি আয়ে ধাক্কা আসতে পারে ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্যনীতির কারণে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলমান আছে। গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপেও প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা সফল হলে রপ্তানি বাণিজ্যের বাধা কেটে যাবে আশা করা যায়।

তারপরও যে দুটি বিষয় অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে, তা হলো বিনিয়োগের স্থবিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। দেশীয় শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গ্যাসের মজুত কমে যাওয়া। রাজনৈতিক পালাবদলের পর বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। গ্যাসের মজুত কমে যাওয়ায় বিদেশ থেকে বেশি পরিমাণে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারকে অন্যায্য চুক্তিও মেনে নিতে হচ্ছে।

জ্বালানি উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, আপাতত জ্বালানির দাম বাড়ছে না। এটা স্বস্তির খবর। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বর্তমানে স্থিতিশীল আছে। কিন্তু ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে দাম বেড়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা প্রয়োজন।

চলতি অর্থবছরের বড় বাধা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। নির্বাচন কবে হবে, নতুন সরকার কী ধরনের নীতি–পরিকল্পনা নেবে, সেটাই ব্যবসায়ী মহলের আগ্রহের প্রধান বিষয়। অন্তর্বর্তী সময়ে কেউ বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটছে ও মব সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক যথার্থই বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি বাড়াতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার এবং মব সংস্কৃতি জরুরিভাবে বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তাও দ্রুত সমাধান করতে হবে। না হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পাবেন না। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক যতটা সম্ভব দ্রত সময়ে শেষ করে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, এটাই প্রত্যাশিত।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটলে অর্থনীতিতেও গতি আসবে।