বিদায়ী উপাচার্যের কর্মকাণ্ডের তদন্ত হতে হবে

সম্পাদকীয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী উপাচার্য শিরীণ আখতার দায়িত্বে থাকতে এত অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন যে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকেরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছেন। সাবেক উপাচার্য দ্বিতীয় মেয়াদে পদায়ন পাওয়ার জন্য জোর তদবির করে ব্যর্থ হয়ে মেয়াদের শেষ দিনে ৩৭ জন কর্মচারীকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দিয়ে গেলেন। এটাকে তাঁর ‘শেষ কীর্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে এই নিয়োগ দেওয়া হয়। উপাচার্য শিরীণ আখতারের শেষ কার্যদিবসে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের ছয়জন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সাতজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এলাকা ফতেপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। এ নিয়ে গত তিন মাসে একই প্রক্রিয়ায় ১০৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আর ২০১৯ সালের নভেম্বরে শিরীণ আখতার উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ১৭২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির ১১৫ আর চতুর্থ শ্রেণির ৫৭ জন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, কোনো শূন্য পদে নিয়োগ দিতে হলে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। এরপর প্রার্থীদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে মৌখিক অথবা ব্যবহারিক পরীক্ষা নিতে হয়। পরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ সুপারিশের আবেদন অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে পাঠানো হয়। সিন্ডিকেট নিয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিদায়ী উপাচার্য এসব নিয়মনীতি মানেননি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মো. আবু তাহেরকে গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ১৯তম উপাচার্য হিসেবে বুধবার তিনি দায়িত্ব নেন।

এ ঘটনা শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটল, তা নয়। ২০২১ সালের ৬ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তাঁর শেষ কর্মদিবসে ‘বিধিবহির্ভূতভাবে’ ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরে এসব নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করে ইউজিসির তদন্ত কমিটি। কিন্তু সেটি কার্যকর হয়নি। শিরীণ আখতারের আগে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করা ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীও শেষ সময়ে এসে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব উপাচার্যের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া নয়, বিধিবহির্ভূত নিয়োগ দেওয়াই তাঁদের প্রধান কাজ।

 বিধিবহির্ভূত নিয়োগ নিয়ে বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। মনোবিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব সহকারী পদে নিয়োগ পাওয়া এক কর্মী যোগ দিতে এলে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগের নেতারা রেজিস্টার অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের এই বলে শাসিয়েছেন যে তাঁদের সংগঠনের বাইরে নিয়োগ পাওয়া কাউকে পদায়ন করা যাবে না। ছাত্রলীগের এক নেতা নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগও তুলেছেন।

গুরুতর এই অভিযোগের দ্রুত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নতুন উপাচার্য মো. আবু তাহেরও স্বীকার করেছেন, এসব নিয়োগ নিয়ম মেনে হয়নি। নিয়ম মেনে যদি নিয়োগ না হয়ে থাকে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিধিবহির্ভূত নিয়োগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

অতীতে উপাচার্যরা সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির বিভিন্ন উপদলের সন্ত্রাসী তৎপরতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। নতুন উপাচার্যের আমলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, এটাই প্রত্যাশিত। অন্যথায় তিনি যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা কথার কথাই থেকে যাবে।