আইন বাতিল হলে মামলা কেন থাকবে

সম্পাদকীয়

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত নীতিগত অনুমোদন হয়। আইনটির বদলে সরকার নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ করবে বলে জানানো হয়েছে।

বিভিন্ন মহলের আপত্তি উপেক্ষা করে ২০১৮ সালে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করা হয়, তখনই আমরা এর প্রতিবাদ করেছিলাম। প্রতিবাদ করেছিলেন সংবাদমাধ্যমের অংশীজন, মানবাধিকার সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক গত ১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করে গত বছরের জুনে একটি সুপারিশমালা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করে, যাতে আইনের দুটি ধারা পুরোপুরি বাতিল ও আটটি সংশোধনের কথা বলা হয়েছিল।

দেরিতে হলেও সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা একে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে প্রশ্ন থাকবে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের গতিপ্রকৃতি কী হবে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব মামলা চলমান আছে, সেগুলো বাতিল করা হবে কি না? পূর্ববর্তী তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ অনেক ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। সাইবার ডিজিটাল আইনেও যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিকর ধারাগুলো ভিন্নভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে নতুন মোড়কে পুরোনো পণ্য বাজারজাত করা হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মানহানির অভিযোগে কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল। নতুন আইনে সেখানে পরিবর্তন এনে কারাদণ্ডের পরিবর্তে জরিমানার বিধান করা হবে।

আমাদের বক্তব্য হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি তো কেবল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি, সরকার ও সরকারের নানা বয়ানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে এটি যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে মানবাধিকারকর্মীরা এই আইনের শিকার হয়ে জেল-জুলুম খেটেছেন।

এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক মোশতাক আহমদ কারাগারেই মারা গেছেন। গত মার্চে একটি খবরের সূত্র ধরে প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে এই আইনে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। এই আইনে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। সেই মামলা এখনো চলমান।

মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন সামনে এসেছে, তা হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলোর কী হবে? আইনটি বাতিল হলে এর অধীনে দায়ের করা মামলাগুলোও বাতিল হওয়া প্রয়োজন। যাঁরা নিবর্তনমূলক এই আইনে বর্তমানে কারাগারে আছেন, তাঁদেরও অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। যাঁরা আইনের শিকার হয়ে জেল-জুলুম ভোগ করেছেন, তাঁরা যাতে ক্ষতিপূরণ পান, সেই ব্যবস্থাও সরকারকে করতে হবে।

রাষ্ট্রের কর্তব্য নাগরিকের মৌলিক ও মানবাধিকারের সুরক্ষা দেওয়া। নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে কাউকে হয়রানি করা নয়। কেউ ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধ করলে প্রচলিত আইনেই তাঁর বিচার হওয়া সম্ভব বলে আইনবিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বড় বিপদ হলো এর বেশির ভাগ ধারাই ছিল জামিন–অযোগ্য। আইনমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, নতুন আইনে জামিন–অযোগ্য ধারাগুলো জামিনযোগ্য করা হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন পাওয়া ছাড়াও অনেক সমস্যা ছিল। সেই সমস্যাগুলো দূর করা হবে কি না, সেটাও প্রশ্ন। নতুন কোনো আইন করার আগে সরকারকে অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আপত্তি ও পর্যবেক্ষণগুলো বিবেচনায় নিতে হবে এবং সবার পরামর্শ ও মতামত নিয়েই তা করতে হবে।