আর কত প্রাণ ঝরলে সরকার সজাগ হবে

শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে একটি যুগোপযোগী সড়ক পরিবহন আইন আদায় করে নিয়েছিল। কিন্তু গত চার বছরে সেই আইন কার্যকর হয়নি একশ্রেণির পরিবহনমালিক ও শ্রমিকের বিরোধিতার কারণে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

গত শনিবার সড়কে পাঁচ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? তারা কি নিছকই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, না কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে? গতকাল রোববার প্রথম আলোয় এসব খবরের পাশাপাশি অদম্য মেধাবী জাহাঙ্গীর আলমের করুণ কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। নালিতাবাড়ী গোল্লারপাড় এলাকায় শেরপুর-নালিতাবাড়ী সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উল্টে মারা যান তিনি। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় জাহাঙ্গীর অপরের জমিতে কাজ করে খরচ জোগাতেন। পরে প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ঢাকায় থেকে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি টিউশনি করে মা ও ছোট ভাইবোনদের খরচ জোগাতেন। জাহাঙ্গীরের মৃত্যু পুরো পরিবারটিকে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

শনিবার সড়ক দুর্ঘটনায় যে পাঁচ শিক্ষার্থী মারা গেছে, তাদের চারজনই মোটরসাইকেলের আরোহী ছিল। তাদের মধ্যে পাবনা-ঈশ্বরদী সড়কে নিহত রেদোয়ান ছিলেন ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএর শেষ বর্ষের ছাত্র। এ রকম আরও কত জাহাঙ্গীর ও রেদোয়ানের জীবন যে অনিরাপদ সড়ক কেড়ে নিয়েছে, তার হিসাব নেই। চলতি বছর জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪৬ জন শিক্ষার্থী। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৮৮৫ জন। এ সংখ্যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ১৬ শতাংশ।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, সরকার কি শিক্ষার্থীদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে? শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে যে সড়ক পরিবহন আইনটি তারা করেছিল, সেটি বাস্তবায়ন না করে ফাইলবন্দী করে রাখার অর্থ কী? যে মালিক ও শ্রমিকেরা সড়ক পরিবহন আইন যাতে বাস্তবায়িত না হয়, সে জন্য এককাট্টা, তাঁরা কি কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের তালিকাটি পরখ করে দেখেছেন? যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন চালক ১৫৩ জন, একই সময়ে আহত চালকের সংখ্যা ২০৬।

এরপরও যদি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর হুঁশ না ফেরে, তাহলে বুঝতে হবে তারা যাত্রীদের তো বটেই, চালকদেরও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে সচেষ্ট। অন্যদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নামে যে সংস্থাটি আছে, দুর্ঘটনা রোধে তারাও কিছু করছে না। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে বিআরটিএ মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার যে খসড়া তৈরি করেছে, তাতে ছাড়পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া সড়কে মোটরসাইকেল নামানো যাবে না বলে শর্ত দেওয়া হয়েছে। এটি ভালো পদক্ষেপ হলেও বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় আছে। এ ধরনের নীতিমালা অন্যান্য যানবাহনের জন্যও প্রযোজ্য। লাইসেন্স ছাড়া কারও কাছে মোটরসাইকেল বিক্রি না করার নির্দেশনাও ইতিবাচক। কিন্তু মোটরসাইকেল বিক্রেতাদের ওপর মোটরসাইকেলচালককে প্রশিক্ষণের শর্ত একেবারই হাস্যকর। এর মাধ্যমে বিআরটিএ তার নিজের দায়িত্ব অন্যের ওপর ন্যস্ত করতে চায়, যা অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য।

সড়কে আর কত প্রাণ গেলে বিআরটিএ তথা সরকার সজাগ হবে? দুর্ঘটনায় এভাবে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।