প্রতিষ্ঠানটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন

সম্পাদকীয়

দিনাজপুর শহরের গুঞ্জাবাড়ি এলাকার দিনাজপুর বধির ইনস্টিটিউটের বাস্তবতা একই সঙ্গে অনুপ্রেরণা এবং হতাশা তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক রাবেয়া খাতুন ৩৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানের আবাসিক শিক্ষার্থীদের খাওয়াদাওয়া, গোসল, পড়ালেখা, ঘুম—সবকিছু্ই দেখভাল করছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে সরকারি কোনো বেতন পান না। শুধু তিনি নন, অন্য শিক্ষকদেরও একই অবস্থা। এটি রাষ্ট্রীয় অবহেলার নমুনা ছাড়া আর কী হতে পারে?

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দিনাজপুর বধির ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হয়েছিল স্থানীয় মানুষের উদ্যোগ ও বদান্যতায়। ১৯৮৯ সালে শুরু করে স্থানীয় দান ও তৎকালীন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠানটি একসময় পাঁচতলা ভবন, স্কুল ভ্যান সার্ভিস, কম্পিউটার শিক্ষা ও সেলাই প্রশিক্ষণের মতো কার্যক্রম নিয়ে উত্তরাঞ্চলের বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের আশা ও ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। ভবনের দরজা ভাঙা, কক্ষগুলো জরাজীর্ণ, দ্বিতীয় তলার কক্ষে ১০টি কম্পিউটার ও কারিগরি যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত, ডাইনিংরুম স্যাঁতসেঁতে। শিক্ষকতা করার ১৮ থেকে ৩৫ বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষকেরা বেতন পাচ্ছেন না। এই বেতনহীনতা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে এক-তৃতীয়াংশ শিশু স্কুলে আসা বন্ধ করেছে। ইনস্টিটিউটের এমন করুণ বাস্তবতার সরাসরি ফল ভোগ করছে শিশুরা। অনেকে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে পরিবারের বোঝা হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

শিক্ষক রাবেয়া খাতুনের নিজেরও দুই সন্তান বাক্‌প্রতিবন্ধী। স্থানীয় মানুষের অনুদানের টাকা থেকে প্রতি মাসে ভাতা পান মাত্র ৬০০ টাকা। প্রধান শিক্ষক নাজনীন আক্তার, রাবেয়া খাতুনসহ অন্য শিক্ষকেরা আসলে ‘মায়ার বাঁধনে’ প্রতিষ্ঠানটিতে থেকে গেছেন। তাঁদের ভাষ্য, ‘আবাসিকে ছেলেমেয়েসহ ২৪ জন শিক্ষার্থী আছে। ওরা কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। ওদের রেখে কই যাব? মায়ায় আটকে আছি ৩৫টা বছর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওদের পাশে থাকতে চাই।’ 

জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করা হয়েছে এবং এটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের অনুদানের টাকা থেকে ভাতা দেওয়া এবং আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মাসিক দুই হাজার টাকা দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা আশা করব, প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের সরকারি বেতনকাঠামোও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি ও এর শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে তাঁরা যে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, এর জন্য তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এসব শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানটিকে মূল্যায়ন করা। বধিরদের এই প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।