নদীদূষণ কী ভয়ানক মাত্রায় পৌঁছেছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনা নদী। সেখানে পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেওয়ায় কয়েক দিন ধরে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠছে। কোথাও কোথাও মরা মাছের স্তূপ জমে উঠছে এবং নদীর চারপাশে পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
মেঘনা নদীর পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতির মূল কারণ হলো অবাধে কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকা জেলার শিল্পকারখানাগুলো থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য মেঘনার পানিতে মিশে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পানির পিএইচ কমে গিয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই দূষণ শুধু জলজ প্রাণীর জীবন বিপন্ন করছে না, স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও ব্যাহত করছে। নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় স্থানীয় ব্যক্তিরা পানীয় জল, সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনে বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না।
এই সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত ও জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, কলকারখানাগুলো থেকে নির্গত বর্জ্য নিষ্কাশন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দিতে হবে। বর্জ্য শোধন না করে নদীতে ফেলা বন্ধ করতে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদীর পানির গুণগত মান নিয়মিত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অক্সিজেনের মাত্রা, পিএইচ এবং অন্যান্য দূষক পদার্থের পরিমাণ নিরীক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। এতে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, নদীদূষণ রোধে স্থানীয় প্রশাসন, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নদী পরিষ্কার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণকেও সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে হবে। চতুর্থত, দূষণের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। নদীর আশপাশের এলাকায় মোবাইল মেডিকেল টিম পাঠিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে দূষিত পানি ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে হবে।
মেঘনা নদীর দূষণ রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। নদীর পানির গুণগত মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ ছাড়া নদী সংরক্ষণে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। নদীর দূষণ ও অক্সিজেন–সংকট কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বড় হুমকি। এই সত্যকে আমলে নিয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।