রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর জবাবদিহি দরকার

বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ যে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত, সে দেশে মানবাধিকারকর্মীদের খুব বেশি তৎপর থাকতে হয় না। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারই নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা দিয়ে থাকে।

কিন্তু যেসব দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত নয়, সেসব দেশে মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন মানবাধিকারকর্মী এবং সংগঠনকে সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা কি নির্ভয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন? এ ক্ষেত্রে সরকারের দাবির সঙ্গে প্রকৃত অবস্থার খুব একটা মিল আছে বলা যাবে না।

গত শনিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণা প্রতিবেদনে যেসব তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। জরিপে দেখা যায়, মানবাধিকারকর্মীদের কাজে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাধা এসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও ক্ষমতাসীন দল থেকে। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে কাজে বাধা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তারা। নানা ধরনের বাধা ও হুমকির মুখে প্রতি ১০ জন মানবাধিকারকর্মীর ১ জনকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে।

দেশের ৩৬টি জেলার তৃণমূল পর্যায়ের ৫০ জন মানবাধিকারকর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সিজিএস প্রতিবেদনটি তৈরি করে। সাক্ষাৎকার দেওয়া ৪৬ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী বলেছেন, দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

৬২ শতাংশ বলেছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি তাঁদের কাজের জন্য ‘অনিরাপদ ও খুবই অনিরাপদ’। গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ জরিপের ফলাফল তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় মানবাধিকারকর্মীরা ভয়ে কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। এর অর্থ তঁাদের মধ্যে একটি ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করছে। 

মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব সরকারের হলেও সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করে থাকে। সংবাদমাধ্যমেও নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরা হয়। যেখানে সরকারের উচিত এসব তথ্য-উপাত্ত আমলে নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উল্টোটাই ঘটে। তথ্য প্রকাশকারী সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয় মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের।

সাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের প্রত্যয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই রাষ্ট্রে এটা কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, অস্বাভাবিকও। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা যখন এসব নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, তখন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আমলে নেননি।

কিন্তু যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‍্যাব ও এর সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন উল্লেখযোগ্য হারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে যায়। কিন্তু মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না।

এখনো পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ও ভিন্নমত দলনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে।

যদি সরকার দেশের ক্ষীয়মাণ মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে ঠেলে না দিতে চায়, তাদের উচিত হবে মানবাধিকারকর্মী ও সংগঠনের ওপর নিত্যনতুন আইনি খড়্গ ও হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা। জনগণের করের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।