খাদ্যচাহিদার জন্য প্রাণিকুলের প্রতিটি প্রজাতিই অন্যান্য জীবের ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির নিয়মের কাছে প্রায় সব প্রাণীই নিরুপায়। তবে শখের বশে শিকার করার প্রবণতা মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রজাতির আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আর সেই শখ প্রায়ই রূপ নেয় অপরাধে।
দেশের হাওরাঞ্চল যেন সেই অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলোর খবরে এসেছে, মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি ও আশপাশের হাওরগুলোতে পাখি শিকার আজ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। জাল পেতে কিংবা গুলি করে যেভাবে দেশি ও পরিযায়ী পাখি হত্যা করা হচ্ছে, তা চূড়ান্ত অসভ্যতা এবং পরিবেশ ভারসাম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্বরূপ। প্রতি শীতেই দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। প্রশাসনের অভিযানে অল্প কিছু পাখি উদ্ধার হলেও শিকার কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।
পেশাদার শিকারিদের দাপট এতটাই বেশি যে গ্রামবাসী প্রতিবাদ করতে ভয় পান। রাতের অন্ধকারে বিষটোপ ফেলার মতো নৃশংস পদ্ধতিও ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকটি উদ্ধার অভিযানের ভিডিও ভাইরাল হলেও পরিস্থিতির উন্নতি দৃশ্যমান হয়নি; বরং এটি প্রমাণ করে যে প্রশাসনের অভিযানের চেয়ে অপরাধী চক্র আরও শক্তিশালী এবং তৎপর।
এ অবস্থায় প্রশাসনকে এর প্রতিকারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রথমত, হাওরাঞ্চলে স্থায়ী নজরদারির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগকে সমন্বিতভাবে মোবাইল টহল চালাতে হবে। জনবলসংকটের অজুহাত দেখিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না। প্রয়োজন হলে স্বেচ্ছাসেবক দল এবং পরিবেশকর্মীদের আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে নজরদারি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় হাট ও বাজারগুলোতে কঠোর তল্লাশি ও তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। বাজারে পাখি বিক্রি হচ্ছে, অথচ তা উদ্ধার হচ্ছে না। যেন কেউ কিছু জানে না, এমনটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু নামমাত্র অভিযান নয়, নিয়মিত এবং নিরবচ্ছিন্ন অভিযান চালাতে হবে।
তৃতীয়ত, সচেতনতা বাড়ানোর কাজকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী করতে হবে। লোকদেখানো কর্মসূচি নয়, বরং গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবক ও তরুণদের বোঝাতে হবে—পাখি শুধু সৌন্দর্যের বিষয় নয়, পরিবেশ রক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাওরের জলজ পরিবেশ বজায় রাখতে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। বিদ্যালয় কলেজ এবং স্থানীয় মসজিদকেন্দ্রিক প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
আমরা আশা করি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করে এই দুষ্টচক্র ভেঙে দেবে। একই সঙ্গে প্রশাসন কেবল মামলা করে দায় সারবে না; বরং শাস্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অপরাধীদের স্পষ্ট বার্তা দেবে। হাওর রক্ষায় পাখি সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনি কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।