গত সোমবার নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সংশ্লিষ্টদের ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো’ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। বৈঠকটি এমন সময়ে হলো, যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। সন্দেহ নেই, সাম্প্রতিক কিছু রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা যেকোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, এ বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। এই নির্দেশনার মধ্যে আছে অপরাধ দমনে সর্বোচ্চ আধুনিক যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার, সব বাহিনীর সমন্বয়ে একটি কমান্ড সেন্টার বা কমান্ড সদর দপ্তর স্থাপন, অনলাইনে থানায় এফআইআর করার সুযোগ সৃষ্টি। নতুন কমান্ড কাঠামো ‘দক্ষতা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে’ দেশের সব বাহিনী ও থানা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর। তাদের আন্তরিকতার ওপরই নির্ভর করবে এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হবে কি না। সেই সঙ্গে আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, যার লক্ষ্য অতীতের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ। সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে রাজনৈতিক দলসহ সমাজের অন্যান্য শক্তির সক্রিয় সহযোগিতাও প্রয়োজন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক তৎপরতা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছে এবং মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়াচ্ছে।’ এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নামে সরকারবিরোধী তৎপরতাও চালানো হচ্ছে, যাকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার–সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের নামে ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তা জনগণের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করার যেকোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এই বছরটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না।’
উন্নয়ন কর্মসূচি কিংবা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নকে সরকারের অগ্রাধিকার দিতেই হবে। আমরা আশা করব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে অবিলম্বে একটি রূপরেখা দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
দাবিদাওয়া নিয়ে মানুষকে জিম্মি করে গত কয়েক মাস ধরেই রাজপথ গরম করা কর্মসূচি দিচ্ছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। এটি শুধু জনভোগান্তিই সৃষ্টি করছে না, জননিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে এ ধরনের লাগাতার কর্মসূচি ঢাকা শহরের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার বিকল্প নেই। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখতে হবে, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে কিংবা নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হন। প্রধান উপদেষ্টা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আমরা আশা করব, তাঁর এই বার্তার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন। এ বিষয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে যে অপপ্রচার চলছে, তার সমুচিত জবাব দিতে হবে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।