২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল কোথায়

সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির ২০টি শহরের ১৯টি যুক্তরাষ্ট্রের। একটি কানাডার অন্টারিও অঙ্গরাজ্যের উইন্ডসর।

অন্যদিকে সবচেয়ে ধীরগতির ২০টি শহরের তালিকায় ঢাকার পরে রয়েছে নাইজেরিয়ার দুই শহর—লাগোস ও ইকোরোদু। ধীরগতির শহরের তালিকায় ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের দুই শহর—ময়মনসিংহ (নবম) ও চট্টগ্রাম (দ্বাদশ) রয়েছে। কলকাতা, মুম্বাইসহ ভারতের আটটি শহরও রয়েছে এই তালিকায়।

ঢাকা শহরের যানজট কমাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে প্রথম মেট্রোরেল। আরও দুটি মেট্রোরেল তৈরি করা হচ্ছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বানানো হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে। প্রথম মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে আংশিক চালু হয়েছে সম্প্রতি। এর আগে আটটি উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। উড়ালসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে চট্টগ্রামেও। কিন্তু এই দুই শহরে সড়কে গতি আসেনি।

সরকারের দাবি, ঢাকাসহ সারা দেশে যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের জন্য কী মূল্য দেশকে দিতে হয়েছে এবং জনগণ কতটা সুফল পেয়েছে, সেটা ভাবার বিষয়। সরকার যখন ঢাকাকে সবকিছুর কেন্দ্র হিসেবে দেখছে, তখন এর গতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সিপিডির গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন ঢাকার নাগরিকদের সড়কে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট যানজটে আটকা থাকতে হয়। বছরে জনপ্রতি নষ্ট হয় ১২৬ ঘণ্টা।

দেড় কোটি জন-অধ্যুষিত ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে লাখ লাখ মানুষ চলাচল করে, তার খুব সামান্য অংশই মেট্রোরেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুফল ভোগ করবে। বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সহজ চলাচল নিশ্চিত করতে নীতিনির্ধারকদের ভাবনা কী? ঢাকা শহরের প্রবেশপথগুলোর নাজুক অবস্থা সড়কের গতি আরও কমিয়ে দিয়েছে। একটি শহরে কেবল বড় বড় উড়াল বা পাতালসড়ক করলেই তো হবে না, সংযোগস্থলগুলোতেও চলাচলের মসৃণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।

যোগাযোগবিশেষজ্ঞ ও নগর-পরিকল্পনাবিদেরা ঢাকা শহরে জনজীবনে গতি আনতে বিকেন্দ্রীকরণ ও পরিকল্পিত নগরায়ণের ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এর কোনোটি আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁরা যখন উড়ালসড়ক করেছেন, মেট্রোরেলের কথা ভাবেননি। যখন মেট্রোরেল করেছেন, এক্সপ্রেসওয়ের কথা মনে রাখেননি। যানবাহনের সংখ্যা ও ধরন নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও তাদের কোনো হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। আর সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।

কিছু অবকাঠামো বানানোই যেন সব, সড়ক ব্যবস্থাপনা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেদিকে কোনো নজর নেই। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং এই চাপ নেওয়ার ক্ষমতা শহরটির নেই। এমন একটি বাস্তবতায় উড়াল-পাতালসড়ক ও মেট্রোরেল কতটা সুফল দেবে?

 উন্নয়নের সঙ্গে সড়কের গতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সরকারের উন্নয়ন-পরিকল্পনায় যদি সেই গতিই না বাড়ে, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলো কেন?

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান একটি দৈনিককে বলেছেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া যোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেই শহরে গতি ফিরে আসছে না। যোগাযোগবিশেষজ্ঞ শামসুল হক ব্যক্তিগত বা ছোট গাড়ির আধিক্যকে সড়কে গতি না আসার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গণপরিবহন মসৃণ ও সাশ্রয়ী হলে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার হয়তো কিছুটা কমবে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া ঢাকা শহরকে গতিশীল করা যাবে না।