মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২০২৩ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যেসব তথ্য–উপাত্ত দিয়েছে, তা উদ্বেগজনক বলে মনে করি। বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দেশের মানবাধিকারের উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরলেও বাস্তব অবস্থা যে তার ধারেকাছে নেই, নিচের পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২২ সালে যেখানে ২২টি বন্দুকযুদ্ধে ১৫ জন মারা যান, সেখানে ২০২৩ সালে ১৫টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে, যাতে মারা গেছেন ৭ জন। অর্থাৎ বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা কিছুটা কমেছে। কিন্তু এই খবর আমাদের স্বস্তি দেয় না, যখন দেখা যায় কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা যান ৬৫ জন, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ১০৫ জনে। এ ছাড়া পুলিশের হেফাজতে ১৩ জন, র্যাবের হেফাজতে ২ জন এবং ডিবি (গোয়েন্দা) পুলিশের হেফাজতে ৩ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা এই দুই সংগঠনই ৩১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ২০২৩ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরেছে। এমএসএফের হিসাবে, কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০২২ সালে যেখানে কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ৯৩টি, এক বছরের ব্যবধানে সেটি বেড়ে এখন ১৬২টি। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাঁদের যথাযথ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালেও নেওয়া হয়েছিল।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের যে দাবি জানিয়েছে, তা যৌক্তিক বলে মনে করি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও এমএসএফের সভাপতি সুলতানা কামাল মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক অবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যাঁরা মানবাধিকারের কথা বলছেন, তাঁদের বৈরিতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ও মানবাধিকারকর্মীদের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে।’
সংবিধান নাগরিককে যেসব মৌলিক অধিকার দিয়েছে, সেগুলো সরকার লঙ্ঘন করতে পারে না। আবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে যেসব অধিকার স্বীকৃত, সেগুলোও জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো মান্য করতে বাধ্য। কয়েক মাস আগে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বৈঠকে সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন আদৌ হয়েছে বলে মনে হয় না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে মানবাধিকারের উন্নয়নও জরুরি।
মানবাধিকারের বিষয়টি রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারের কোনো সংস্থা যদি সেটি পালন না করে, তাহলে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারেও সেই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সেটি কীভাবে হবে? যে বাহিনীর সদস্য বা সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই বাহিনীকে দিয়ে তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে না। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন তদন্ত কমিশন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা হোক।
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এর ব্যত্যয় কেউ করলে তাঁকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।