দুর্নীতি উৎসাহিত হয়, এমন শিথিল বিধি কেন

সম্পাদকীয়

সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার নির্ধারিত নিয়ম শিথিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণবিধিমালা সংশোধনীর যে খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে, তাতে শঙ্কিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হিসাব নিজ মন্ত্রণালয়ে দেওয়ার নিয়মটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে নিশ্চিত করেই ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর জবাবদিহির বিষয়টি শিথিল হবে এবং অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ ও দুর্নীতিতে আরও উৎসাহিত হবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে শূন্য সহিষ্ণু নীতি, তার সঙ্গে এই প্রস্তাব সাংঘর্ষিক।

দ্য ডেইলি স্টার-এর খবর জানাচ্ছে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং বা যাচাই-বছাই সম্পন্ন হয়েছে। এটি এখন প্রশাসনিক উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হবে। সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী, ‘যদি প্রয়োজন হয়’, তাহলে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সরাসরি তঁার কাছ থেকে না নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়া যাবে।

বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী, একজন সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এরপর পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দিতে হয়। শুদ্ধাচার চর্চা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্যই নির্দিষ্ট সময় পরপর সম্পদের হিসাব দেওয়া জরুরি। প্রথমে এক বছর অন্তর সেটা প্রদানের নিয়ম ছিল। পরে সেটা শিথিল করে পাঁচ বছর করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাকরিতে প্রবেশের সময় সম্পত্তির তথ্য দিলেও পরে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী জমার বিষয়টিতে কেউ আর গুরুত্ব দেন না।

বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০২৩ সালে বৈশ্বিক দুর্নীতির যে সূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের এই অবনতির পেছন যে কটা মূল কারণ চিহ্নিত করে, তার মধ্যে সরকারি খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা বাড়ার বিষয়টি অন্যতম। বিশেষ করে সরকারি ক্রয়, প্রকল্প চুক্তি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি দুর্নীতি দেখা গেছে।

দুর্নীতির এই অবনতিশীল বাস্তবতায় সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি যখন আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন, তখন উল্টো বিদ্যমান নিয়মটিই শিথিল করার আয়োজন চলছে।

অর্থ পাচারের বিষয়টি যেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় উদ্বেগের কারণ, সেখানে খসড়া প্রস্তাবে সরকারি চাকরিজীবী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিদেশে সম্পদ অর্জন এবং স্থাবর সম্পত্তি স্থানান্তর-সংক্রান্ত বিধি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বিধি অনুযায়ী, সরকারের অনুমতি ছাড়া বিদেশে সম্পদ অর্জন ও স্থাবর সম্পত্তি করা যাবে না। প্রশ্ন হলো, সরকারের অনুমতি নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশে সম্পদ অর্জন ও ব্যবসা করা কতটা ন্যায়সঙ্গত? এ ধরনের বিধিকৌশল অর্থ পাচারকে কি উৎসাহিত করে না?

এই বিধি কি বৈষম্যমূলক নয়? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান যথার্থই বলেছেন, এ ধরনের বিধি দুর্নীতিগ্রস্ত চাকরিজীবীদের বিদেশে অর্থ পাচারের সুযোগ তৈরি করে, বিশৃঙ্খলা বাড়ায় প্রশাসনে।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা যুগোপযোগী করা সময়ের দাবি। কিন্তু সংশোধন করে বিধি এমনভাবে শিথিল করা ঠিক হবে না, যাতে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করা আবশ্যক।