মানের অবনতি রোধ করবে কে

সম্পাদকীয়

দুই বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমার খবরটি হতাশাজনক। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২২ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে (এপিএসসি) দেখা যায়, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেন) প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি।

২০২১ সালে কমে হয় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি। ২০২২ সালে সেটি আরও কমে হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি। বিপরীতে ২০২০ সালে শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১ জন; ২০২১ সালে তা কমে হয় ২ কোটি ৯০ হাজার ৫৭ জন এবং ২০২২ সালে বেড়ে হয় ২ কোটি ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯১ জন।

করোনার সময় অনেক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (কিন্ডারগার্টেন) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত দুই বছরেও সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার চালু না হওয়ার কারণ কী? এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কি অন্য পেশায় চলে গেছেন?

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক উত্তম কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লার্নিং সেন্টার (শিক্ষাকেন্দ্র) বন্ধ করে দেওয়ায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু ওই সব শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা কোথায় গেল, সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। যেসব স্থানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানকার শিশুদের শিক্ষার জন্যই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এগিয়ে এসেছিল। তাদের শূন্যস্থান কীভাবে পূরণ করা হয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর অজানা।

কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিয়ে বেশি শিক্ষার্থী পাঠদানের পরিণতি যে কী হয়, সেটাও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অন্য এক প্রতিবেদনে স্পষ্ট। শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০২২’ অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়ও দুর্বল।

শেষোক্তদের মানও তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী নয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যারা এনজিও পরিচালিত স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ে, তাদের তুলনায় সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। যে শিশুরা পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ে, তাদের দক্ষতা তুলনামূলক ভালো হয়ে থাকে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, ‘এই জরিপের ফল আমাদের দেশের শিক্ষার মানের একটি হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরেছে। শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে কথা বললেও কিছুই পরিবর্তন হয়নি।’

এর অর্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের পদ্ধতি ও পরীক্ষা নিয়ে অনেক শোরগোল তোলা হলেও শিক্ষার মানের অবনতি ঠেকানো যায়নি। শিক্ষার্থী বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। প্রাথমিক স্তরে হাজার হাজার শিক্ষকের পদ খালি রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করা যায় না।

আমাদের শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যত আগ্রহী, প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে ততটাই উদাসীন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচটি শ্রেণি থাকলেও অনেক বিদ্যালয় চলে তিন বা তারও কম শিক্ষক দিয়ে। আগের তুলনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা বিভাগের তদারকিও কমে গেছে।

শিক্ষার অভিভাবকদের সুমতি হবে এবং প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে নজর দেবেন, এটাই প্রত্যাশিত।