রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ করা ইসির কাজ নয়

সম্পাদকীয়

১৮ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগপর্যন্ত ভোটের প্রচারের বাইরে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের অনুমতি না দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে যে অনুরোধ জানানো হয়েছে, তার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে পাঠানো ইসির চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে, ভোটাররা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন, এমন কোনো সভা-সমাবেশ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেকে সবাইকে বিরত রাখা বাঞ্ছনীয়। ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন।

পরদিন; অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার কথা। এই সময়ে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হতে পারবে না, এ কথার অর্থ কি নির্বাচন কোনো অরাজনৈতিক বিষয়?

নির্বাচন কমিশনের দাবি, এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নাকি নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে ও ভোটাররা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচনটি যাতে সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশন সেটা না করতে পেরে এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধের পাঁয়তারা করছে। এই কাজ ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়ও তৎকালীন নির্বাচন কমিশন করতে সাহস পায়নি।

এর আগে নির্বাচন কমিশন বলেছিল, মানুষ বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনার সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে আসবে। কিন্তু বিভিন্ন নির্বাচনী আইন ভঙ্গ ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি, লাঠালাঠি ছাড়া এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে না।

একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধান শর্ত হলো প্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ, যাতে ভোটাররা তাঁদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারেন। নির্বাচন কমিশন সেই পরিবেশটিই তৈরি করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীরা যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিও অব্যাহত রেখেছে। এর অর্থ নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট মূল সমস্যাটিই তারা সযত্নে এড়িয়ে গেছে।

নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রচারের বাইরে সব রাজনৈতিক কর্মসূচি বাতিল চেয়ে যে চিঠি দিয়েছে, সেটি কেবল সংবিধানবিরোধী নয়, মানবাধিকারেরও পরিপন্থী। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে আছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

নির্বাচন কমিশন ‘যেকোনো মূল্যে’ নির্বাচন করতে নাগরিকদের সেই অধিকার হরণ করতে পারে না। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সভা-সমাবেশ বন্ধ করতে পারে না। তারা যদি বিশেষ কোনো স্থানে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা আছে মনে করে, তাহলে সাময়িক বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, এর বেশি নয়।

নির্বাচনের আগে সরকার যে দেশব্যাপী গণহারে ধরপাকড় চালাচ্ছে, ২০ হাজারের বেশি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে, তঁাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধ কমিশন টুঁ–শব্দটিও করতে পারেনি। এখন তারা নাগরিকের সভা–সমাবেশ করার মৌলিক অধিকারও খর্ব করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের এই চিঠি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। দেশের সংবিধান ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের প্রতি যদি তাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকে, তাদের অবশ্যকর্তব্য হবে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করা। নির্বাচন কমিশনের কাজ নির্বাচন করা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করা নয়।