বাকি ৩৬৪ দিনও নারীর কথা মাথায় রাখুন

সম্পাদকীয়

আন্তর্জাতিক নারী দিবস, ২০২৪-এর প্রতিপাদ্য হলো ‘নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। জাতিসংঘ এ উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বলেছে, একটি সমৃদ্ধিশালী ও সুস্থ পৃথিবী গড়তে জীবনের সব ক্ষেত্রে জেন্ডার-সমতা ও নারীর ভালো থাকার প্রয়োজনীয়তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।

জাতিসংঘ বলছে, সংঘর্ষ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বিশ্বের ৭৫ ভাগ রাষ্ট্র ২০২৫ সাল নাগাদ সেবা খাতে ব্যয় কমিয়ে দিতে পারে। এর দরুন নারী ও কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেন নারীর জন্য বিনিয়োগ করতে হবে, তার পেছনে বেশ কটি কারণ দেখিয়েছে তারা। এর প্রথম কারণটি হলো নারীর প্রতি বিনিয়োগ মানবাধিকার ইস্যু।

তা ছাড়া সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণ, জেন্ডারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, সবুজ অর্থনীতি ও যত্নশীল সমাজ গঠন, নারীবাদী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করা ও সর্বোপরি সর্বত্র নারীর উপস্থিতিকে দৃঢ় করতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এই হলো জাতিসংঘের মত।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে এবার বাংলাদেশের দিকে তাকাই। বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের নারীরা দৃষ্টান্ত। এ নিয়ে তর্কবিতর্কের সুযোগ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীদের ভূমিকার কথা একবার চিন্তা করুন। সন্তান, সম্পদের সুরক্ষা তো বটেই, দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় নারীর অবদান সারা বিশ্বে স্বীকৃত। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে ছাত্রীরা ভালো করছে। শুধু তা-ই নয়, চাকরি ও সেবা খাতেও তাদের এগিয়ে যাওয়া লক্ষণীয়। খেলাধুলায় পরপর সাফল্য এসেছে মেয়েদের হাত ধরে। এই তো গত বছরই নারী দিবসে প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানায়, প্রশাসনে ক্রমে নারীদের উপস্থিতি বাড়ছে।

এবার এই অগ্রগতির উল্টোপিঠটা দেখি। আমাদের সংবিধান পাঁচ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সমানাধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছর পরও নারীদের প্রতি বৈষম্য কি ঘুচল? ধরুন, খাদ্য। গত বছর ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার কিশোরী ও নারীরা আছে পুষ্টি–সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ইউনিসেফ বলে, এ দেশের মেয়েরা অপুষ্টির দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে।

যে নারীরা পোশাক খাতে বিপ্লবের সূচনা করেছেন, গবেষণা বলছে অঞ্চলভেদে দেশে নারী পোশাকশ্রমিকদের মজুরিতে ৫১ থেকে ৬০ শতাংশ বৈষম্য রয়েছে। সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার তো দূর কি বাত, এই সমাজ এখনো সম্পদ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে নারীকে মানতে পারে না। হাসপাতালগুলোয় নারীদের আসনসংখ্যা এখনো পুরুষের সমান নয়। প্রশাসনে নারীদের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বড় প্রকল্পগুলো পরিচালনার দায়িত্ব তাঁরা পান না বললেই চলে। সতীর্থ পুরুষ খেলোয়াড়দের চেয়ে নারীরা বেতন কম পান। অথচ তাঁদের সিংহভাগ সমাজের পশ্চাৎপদ পরিবারগুলো থেকে হাজারো বাধা ডিঙিয়ে খেলতে আসেন।

এখনো নারীদের জন্য নিরাপদ শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই, ট্রেনে-বাসে নারী ও কন্যাশিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুল-কলেজ বা কর্মস্থলে যেতে তাদের জন্য গণপরিবহন একটা আতঙ্কের নাম। বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে অষ্টম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। এই তো গতকাল বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনসূত্রে প্রথম আলোর খবর বলছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের ওপরে।

গবেষণা, সমীক্ষা আর সূচকে দেশে নারীর প্রতি বৈষম্যের যে ছবি, তা বেদনাদায়ক। আমরা মনে করি, নারীর সম-অধিকার প্রতিদিনের ইস্যু, জরুরি ইস্যু। শুধু ৮ মার্চ নারীর প্রতি সমানুভূতি প্রদর্শন না করে, বছরের বাকি ৩৬৪ দিনও জেন্ডার সমতার কথা মাথায় রেখে কাজ করুন। কারণ, নারীর জন্য বিনিয়োগ মানে দেশ ও জাতির জন্য বিনিয়োগ।