অনিয়মের নিয়োগ বন্ধ হোক

সম্পাদকীয়

‘অধ্যাপক বেশি, প্রভাষক কম’ শিরোনামে প্রথম আলোয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অস্বাভাবিক। তবে এসব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা সেই অস্বাভাবিকতাকে স্বাভাবিক এবং অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকবলকাঠামো পিরামিড আকৃতির হয়ে থাকে, যেখানে অধ্যাপকের চেয়ে প্রভাষকের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়েছে ঠিক এর উল্টো। অর্থাৎ তারা উল্টো পিরামিড কাঠামোয় অভ্যস্ত। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২০) অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ১৫ হাজার ৪২৬ জন। তাঁদের মধ্যে পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রিধারী শিক্ষক ৬ হাজার ৬৫০ জন।

শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপকের সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজারের বেশি। সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষক রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক পদে, ৫ হাজারের বেশি। দেখা যাচ্ছে, মোট শিক্ষকের ২৯ শতাংশ অধ্যাপক পদে রয়েছেন। অন্যদিকে প্রভাষক রয়েছেন ১৭ শতাংশের মতো।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, প্রতিটি বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকের পদসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ ব্যবস্থায় ইচ্ছেমতো পদসংখ্যা বাড়িয়ে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপকের মূল পদ সাতটি। কিন্তু বিভাগটিতে এখন অধ্যাপক রয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে ৫ জনকে নেওয়া হয়েছে ‘পুনর্বিন্যাস বা রিস্ট্রাকচারিং’ সুবিধায়। এ বিভাগে কোনো প্রভাষক নেই।

আমাদের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন প্রয়োজনের বেশি অভিজ্ঞ শিক্ষক তথা অধ্যাপক আছেন, তখন শিক্ষার মান কোন অবস্থায় আছে, তা–ও বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যদি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকে, তাহলে এত অধ্যাপক কী করছেন? দেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন প্রয়োজনের বেশি অধ্যাপক নেওয়া হচ্ছে, তখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে অনভিজ্ঞ ও নবীন শিক্ষক দিয়ে।

জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ৪৬ জন। অধ্যাপক মাত্র একজন। গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আছেন মাত্র তিনজন। এর মধ্যে একজন চুক্তিতে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে ৩৪টি বিভাগ রয়েছে।

সাধারণত অধ্যাপক হতে হলে যোগ্যতা, শিক্ষকতা ও জ্ঞানচর্চার সুনাম, ভালো মানের গবেষণা ও প্রকাশনা থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এসব না থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষক কেবল জ্যেষ্ঠতার কারণে কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে অধ্যাপক হয়ে যান। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও এসব অধ্যাপকের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধায় সরকারের বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে। আবার নিচের পদগুলোতেও দ্রুত পদোন্নতি হলেও সেখানে শূন্যস্থান পূরণ করা হয় না।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক সংখ্যায় ভারসাম্য থাকছে না। পদোন্নতির জন্য অপরের গবেষণা চুরি করার অভিযোগও আছে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে গুরুতর অভিযোগ আছে। সেখানে অভিজ্ঞ শিক্ষক যান না। আবার অভিজ্ঞ শিক্ষক থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁদের নেওয়া হয় না। যদি অভিজ্ঞ শিক্ষকই না থাকেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা কাদের কাছে শিখবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলবে কীভাবে?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকবলকাঠামোয় পুনর্বিন্যাস ও সমতার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন শিক্ষাবিদেরা। সহজে অধ্যাপক হওয়ার বিপদ সম্পর্কেও তঁারা সতর্ক করে দিয়েছেন।

কিন্তু আমাদের উচ্চশিক্ষার অভিভাবকেরা তাতে আদৌ কর্ণপাত করবেন কি? ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়মের নিয়োগ হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু অতীতে যেসব অনিয়মের নিয়োগ হয়েছে, সে জন্য নিয়োগকর্তাদের জবাবদিহি আদায় করা প্রয়োজন বলে মনে করি।