ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) মধ্যকার দ্বন্দ্বটি ব্যক্তিগত হলে আমাদের কিছু বলার ছিল না। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার প্রায় দুই কোটি মানুষের পানি পরিষেবা জড়িত, সেই প্রতিষ্ঠানের দুই শীর্ষ ব্যক্তির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ মোটেই সুস্থতার লক্ষণ নয়।
যেকোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান চলে পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। কিন্তু যিনি এক যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি হিসেবে পদায়িত আছেন—তাকসিম এ খান, তিনি বোর্ডের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনাকে আমলে নেওয়ারই প্রয়োজন মনে করেন না। নিজের খেয়ালখুশিমতো কাজ করেন। বিদেশে ছুটিতে থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে এমডির দায়িত্ব পালন করেন।
সম্প্রতি একটি টিভি টক শোতে ওয়াসার নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থা তুলে ধরেছেন ওয়াসার চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। এই প্রেক্ষাপটে ১১ মে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি সংগঠনের নামে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওয়াসা চেয়ারম্যান এর জবাব দিতেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠানটির এমডির সমালোচনা করে পাল্টা চিঠি দেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংস্থাটিকে অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। চেয়ারম্যানের অভিযোগ এমডি ওয়াসাকে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো ‘স্বৈরাচারী’ কায়দায় পরিচালনা করেন। তাকসিম ওয়াসা বোর্ডকে দীর্ঘদিন ধরে অবমাননা করলেও বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওয়াসা চেয়ারম্যান এমডির বিরুদ্ধে বোর্ডের সঙ্গে অসহযোগিতা, অসদাচরণ এবং পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন আইন ১৯৯৬-এর বিধি অমান্য করারও অভিযোগ এনেছেন তিনি।
বোর্ড চেয়ারম্যানের অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, যে ব্যক্তিই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাঁকেই চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। এমডি ঢাকা ওয়াসার বাজেটে কোটি কোটি টাকা বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখেন এবং ইচ্ছেমতো বাজেটবহির্ভূত খরচ করেন। এমডি তাকসিম ক্ষমতার দাপট দেখাতে নিজের সুবিধামতো প্রশাসন তৈরি করে রেখেছেন।
এগুলো খুবই গুরুতর অভিযোগ। সরকার যেখানে দুর্নীতির বিষয়ে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর কথা বলছে, সেখানে ওয়াসার এমডি স্বেচ্ছাচারী কায়দায় ঢাকা ওয়াসা পরিচালনা করেন কীভাবে? ঢাকা ওয়াসার প্রধান দায়িত্ব নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ করা। কিন্তু তারা যে পানি সরবরাহ করে, তা না ফুটিয়ে খাওয়া যায় না। অনেক স্থানে দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ করা হয় বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকা ওয়াসা শত শত কোটি টাকার প্রকল্প নিলেও নগরবাসীর পানি সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। যে হারে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।
সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াসা প্রশাসনের কিছু বিষয়ে বোর্ড হস্তক্ষেপ করার কারণেই বোর্ড তথা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চটে যান এমডি। অভিযোগ আছে, বোর্ড চেয়ারম্যানকে চাপে রাখতে ওয়াসার বিভিন্ন সংগঠনকে ব্যবহার করে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নালিশ করিয়েছেন তিনি।
এমডির বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ ও ঢাকা ওয়াসার কাজকর্ম নিয়ে তদন্তের বিষয়ে চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। ওয়াসার চেয়ারম্যান বলেছেন, ওয়াসার অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে গ্রাহকদের পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।
এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কী হবে—এমডির স্বেচ্ছাচারিতা মুখ বুজে মেনে নেওয়া, না প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া? জনগণের করের অর্থে পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠান এভাবে চলতে পারে না। ঢাকা ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।