মাদকের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি ঘোষণা করেছে। এরপরও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে মাদকের চোরাচালান। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, শুধু কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ইয়াবা বড়ি উদ্ধার চার বছরের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে ক্রিস্টাল মিথ বা আইসের মতো মাদকও দেশে প্রবেশ করেছে। মাদক চোরাচালানের ভয়াবহ এই চিত্রের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, এর আত্মস্বীকৃত কারবারিরা তাঁদের গুরুপাপের জন্য লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছেন।
প্রথম আলোর খবরে জানা যাচ্ছে, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে ২০১৯ সালে কক্সবাজারে ১ কোটি ৭৭ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছিল। এ বছরের ১০ মাসেই সেখানে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার সংখ্যা ৩ কোটি ২৮ লাখ। ২০২১ সালে যেখানে ২৪ কেজি আইস উদ্ধার হয়েছিল, এ বছর সেখানে ১৯২ কেজি আইস উদ্ধার হয়েছে।
২০১৮ সালে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছিল। সেই অভিযানে মাঠপর্যায়ের মাদক কারবারিরা ধরা পড়লেও বড় কারবারি কিংবা পৃষ্ঠপোষকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। অভিযানকালে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টেকনাফ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১০১ মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তে মাদক চোরাচালান কমবে। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটেছে। সম্প্রতি ওই মাদক কারবারিদের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর তাঁদের আত্মসমর্পণ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদক ব্যবসার সর্বোচ্চ শাস্তি যেখানে মৃত্যুদণ্ড, সেখানে তাঁদের দেড় বছরের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেওয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ৮৩ জনই পলাতক। পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ৪ ভাইসহ ১২ জন নিকটাত্মীয়।
রায় ঘোষণাকালে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠিন অবস্থান, ধারাবাহিক অভিযান, অনাকাঙ্ক্ষিত ক্রসফায়ারের কারণে অনেকে (মাদক কারবারি) নিজেদের রক্ষা করার অভিপ্রায়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
কক্সবাজারের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও একই ধারণা পোষণ করেন। তাঁরা মনে করেন, মাদক কারবারিরা আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গিয়েছিলেন নিজেদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্যই।
তাঁদের আত্মসমর্পণের পর এক দিনের জন্যও তাই মাদক চোরাচালান বন্ধ হয়নি। কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁদের চক্রের সদস্যরা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর গডফাদাররা অনেকে সরাসরি, আবার অনেকে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মাদক চোরাচালান করছেন।
পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র ও আদালতে সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যে গরমিল থাকায় আত্মস্বীকৃত মাদক কারবারির লঘু শাস্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্ত সংস্থার এ ধরনের দুর্বলতা ও গাফিলতি দেশে মাদক কারবারিদের পার পেয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাদক চোরাচালানের বাহক ও মাঠপর্যায়ের বিক্রেতারা ধরা পড়েন। বাস্তবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে মাদকের চোরাচালান বন্ধ করা সম্ভব নয়। একজন ধরা পড়লে বিকল্প আরও অনেকে এ কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন।
মাদক প্রবেশের উৎসমুখ খোলা রেখে ও বড় কারবারিদের রক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা করে মাদকের চোরাচালান বন্ধ সম্ভব নয়। মাদকের ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী।
সে কারণেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তাঁরা। লোকদেখানো অভিযান নয়, মাদকের গডফাদারদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তে নজরদারি আরও কঠোর করতে হবে।