ধানবীজ রক্ষায় কৃষকের উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক

সম্পাদকীয়

ধানের দেশ বাংলাদেশে একসময় প্রাকৃতিক উপায়ে উদ্ভাবিত বৈচিত্র্যময় অসংখ্য প্রজাতির ধানের চাষ হতো। কৃষকই তাঁদের ঘরে সেসব বীজ সংরক্ষণ করতেন এবং ছড়িয়ে দিতেন বহুজনের মধ্যে।

জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে। ফলে কম জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে উচ্চফলনশীল বীজের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। কৃষকের কাছ থেকে বীজ চলে গেছে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে। গবেষণাগারে উদ্ভাবিত হচ্ছে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ। তাতে বৈচিত্র্য হারিয়ে এখন হাতে গোনা কয়েক প্রজাতির ধানেরই চাষ হচ্ছে।

এ বাস্তবতায় হারিয়ে গেছে অসংখ্য প্রজাতির ধান। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ ধানের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থেকে নিজ উদ্যোগে নানা প্রজাতির বীজ সংরক্ষণ করে টিকিয়ে রাখছেন দেশি প্রজাতির ধান।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবলই গ্রামে গড়ে উঠেছে এ রকম একটি ধানের বীজ সংরক্ষণাগার, যেটির নাম দেওয়া হয়েছে বীজ–ব্যাংক। গ্রামটির একটি আধা পাকা ঘরে চলে বীজ–ব্যাংকটির কার্যক্রম। আট বছর আগে শুরু হওয়া ব্যাংকটিতে এ পর্যন্ত ২৬১ জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর উদ্যোক্তারা খুব পরিকল্পিত ও সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখছেন বিলুপ্তপ্রায় দেশি ধানবীজের প্রাণ।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বিলুপ্তপ্রায় দেশি ধানের বীজ সংরক্ষণ ও চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে এই বীজ–ব্যাংক। এ জন্য তারা প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান উঠলে বীজ বিনিময় ও নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। এতে সারা দেশ থেকে কৃষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিকেরা যোগ দেন। প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ধানবীজের প্রাণ বাঁচাতেই মূলত এই উৎসবের আয়োজন।

২০১৫ সালে বীজ–ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইউসুফ মোল্লা নামের একজন কৃষক। একটি পরিবেশবাদী সংগঠন তাতে সহায়তা দেয়। দুই বছর আগে তিনি মারা গেলেও তাঁর দেখানো পথেই কাজটি এগিয়ে নিচ্ছেন গ্রামের কৃষকেরা। বীজ–ব্যাংকটির একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে, যারা প্রতি মাসে বসে তাদের করণীয় ঠিক করে।

দেশি প্রজাতির ধানের বীজ সংরক্ষণে দেশের নানা অঞ্চলের কৃষকেরা বীজ বিনিময় করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ১৮০ কৃষকের মধ্যে বীজ বিতরণ ও বিনিময় করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী উৎসব থেকে এক কেজি বীজ নিলে সেই ধান চাষ করে পরের বছর অন্তত পাঁচ কেজি ফেরত দিতে হয়। বীজ বিনিময় ছাড়াও এই ব্যাংকের উদ্যোগে বীজের ভ্রূণ বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্লট তৈরি করে ধানের চাষ করা হয়।

বিলুপ্তপ্রায় দেশি ধানের বীজ সংরক্ষণ ও চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার বীজ–ব্যাংকের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। বীজ–ব্যাংক এ ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা ছড়িয়ে পড়ুক দেশের অন্যত্রও।