চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত জাহাজভাঙা শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসে এই খাত থেকে, হাজার হাজার টন ইস্পাত পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয়। কিন্তু এই আপাত–সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার অধ্যায়, সেটি হলো শ্রমিকদের চরম দুর্দশা। এই খাতের শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন যাপন করবেন, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের জীবনযাপনের এক বেদনাদায়ক চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, এই শিল্পের শ্রমিকেরা ৬৪ বর্গফুটের স্যাঁতসেঁতে কক্ষে গাদাগাদি করে থাকছেন তিন থেকে পাঁচজন করে, যেখানে রান্না ও শোবার জায়গা একই। নেই স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নেই পরিচ্ছন্নতার কোনো ব্যবস্থা। সেখানকার এমআই ও জামাল কলোনির মতো শ্রমিক আবাসনগুলো যেন বসবাসের অযোগ্য।
এই দুর্দশা শুধু আবাসনসংকটে সীমাবদ্ধ নয়; শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে যে তথ্য সামনে এসেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। একজন দক্ষ ফিটারম্যান ২০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রতি ঘণ্টায় ৫৫ টাকা, অর্থাৎ দিনে মাত্র ৪৪০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। এটি দেশের অন্য শহরে একজন দিনমজুরের আয়ের প্রায় অর্ধেক। সরকার ঘোষিত দৈনিক ন্যূনতম মজুরি যেখানে ৮০০ টাকা, সেখানে এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিকেরা পাচ্ছেন তারও অনেক কম। এমনকি কাটার বা ওয়্যার শ্রমিকদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি আরও কম, মাত্র ২৪০-৩৫০ টাকা। এই মজুরি দিয়ে একজন শ্রমিক কীভাবে নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করবেন, তা একটি বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্যানুসারে, এই শ্রমিকদের নিয়োগপত্র নেই, নেই সবেতন ছুটি বা উৎসব বোনাস। ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগের কারণ হতে পারে এমন বিষাক্ত উপাদান, যেমন অ্যাসবাস্টাস, পিসিবি ও টিবিটি নিয়ে কাজ করেও তাঁদের জন্য কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
মালিকপক্ষ অবশ্য এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করে। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) ভারপ্রাপ্ত সচিবের দাবি, এই শিল্পের বেতন পোশাক কারখানার চেয়ে বেশি। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কলকারখানা পরিদর্শক মো. টিপু সুলতান বলছেন, তাঁরা দু-একটি কারখানাকে নোটিশ দিয়েছেন, কিন্তু তাতে শ্রমিকদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
জাহাজভাঙা শিল্পে এই শ্রমিক শোষণ চলতে পারে না। মালিকপক্ষ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত অবিলম্বে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। শুধু আইন থাকা যথেষ্ট নয়, তার কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন।