রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন কী করছে

সম্পাদকীয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মব সহিংসতা ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে ছয়জন ডিনকে যেভাবে তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, সেটাকে এককথায় ‘মবের মুল্লুক’ বলা যায়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রশাসনের অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয়। যে তিয়াত্তরের অধ্যাদেশে দেশের চারটি পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন অনেকটাই নিশ্চিত করা হয়েছে, এ ঘটনা তারও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এই নৈরাজ্য সংঘটিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাহউদ্দিন আম্মারের নেতৃত্বে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব নেওয়া ডিনদের মেয়াদ শেষ হয় ১৭ ডিসেম্বর। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিন নির্বাচন সম্ভব না হওয়ায় ১১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন ১২টি অনুষদের ডিনদের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ছয়জন ডিনকে ‘আওয়ামীপন্থী শিক্ষক’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের পদত্যাগের জন্য রাকসুর জিএস সময় বেঁধে দেন। শুধু সময় বেঁধে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, গত রোববার (২১ ডিসেম্বর) তিনি নিজে একটি ‘পদত্যাগপত্র’ লিখে এনে রাকসু ভবনের সামনে থেকে ডিনদের ফোন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য ক্লাস নিচ্ছেন, শুনতে পেরে তাঁর বিভাগেও যান। এরপর একদল শিক্ষার্থী তিনজন ডিনসহ উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টর, রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসন ভবনের সব দপ্তরের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোববার সন্ধ্যায় ডিনদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। সেখানে ডিনরা তাঁদের রুটিন দায়িত্ব পালনে অপারগতা জানিয়ে লিখিত আবেদনপত্র দেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাকে গত ১৬ মাসের মব সহিংসতা থেকে আলাদা করে দেখার কোনো অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি না। গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের লাঞ্ছনা, জোরপূর্বক পদত্যাগের মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষকদের সুরক্ষায় শক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী নিজেদেরকে সব আইনকানুনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করছেন। প্রকৃতপক্ষে এ কারণেই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

বিগত আওয়ামী লীগ আমলে ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় যেসব শিক্ষক ও কর্মচারীরা আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড করেছেন, তাঁদেরকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের মাধ্যমেই তাঁদের শনাক্ত করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাঁদের শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু অভ্যুত্থানের ১৬ মাস পর এসে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যখন মব সহিংসতা তৈরি করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রশাসন যখন বেআইনি চাপের কাছে নতিস্বীকার করে, তার চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কি হতে পারে। উল্লেখ্য, তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ মেনেই ডিনদের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।

আমরা মনে করি, এ ধরনের নৈরাজ্যকর পরিবেশ একদিকে যেমন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে, অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার তৈরি করে। এমন ভয়ের পরিবেশে শিক্ষকদের পক্ষে কি শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা সম্ভব?

রাকসুর যে জিএসের বিরুদ্ধে এই নৈরাজ্য ও ভয়ের পরিবেশ তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসেও তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ উঠেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ঘটনায় তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেয়নি?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে মব সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবশ্যই কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।