সরকার কি আদৌ সজাগ হবে

সম্পাদকীয়

দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান একই স্থানে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো বছর এক ধাপ এগোলে, পরের বছর পিছিয়ে যায়। কখনো এই অবনমন আগের অগ্রগতির চেয়েও বেশি। আমরা যদি ২০১৯ সাল থেকে হিসাব করি, ১৪তম স্থান থেকে ১২তম স্থানে চলে এসেছি।

বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। এর আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্যে এক ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ১৪৭তম, গত বছর ছিল ১৪৬তম। ২০২০ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। এর আগের ১৪তম অবস্থান থেকে ২ ধাপ নিচে।

দুর্নীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে টিআই ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের জন্য সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারকে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে যে এই ক্ষমতার অপব্যবহার মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে, তা ব্যাখ্যা করতে টিআই বা অন্য কোনো সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না। খোলাচোখেই দেখা যায় কীভাবে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া সব দেশের পেছনে আমরা।

বাংলাদেশের ওপরে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণাকারী সরকারের জন্য এটা মোটেই স্বস্তিকর নয়। উদ্বেগের কথা হলো গণমাধ্যমে কিংবা বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় যেসব দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে, সরকার তা যাচাই করারও প্রয়োজন বোধ করে না; সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে।

কিন্তু টিআইয়ের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো সরকারের নীতিনির্ধারকদের গা জ্বালা করলেও বিরোধী দলে থাকতে তাঁরা এ সংস্থার তথ্যকেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন এবং অতীতে যঁারা ক্ষমতায় ছিলেন, এটি উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। টিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। চারবার বিএনপির আমলে, একবার আওয়ামী লীগ আমলে। বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন না হলেও এর কাছাকাছি অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। অস্বীকারের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বন্ধ না হলে দুর্নীতির প্রকোপ কখনোই কমবে না।

টিআই বলেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানো হলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এর বাস্তবায়নে কৌশলগত কোনো পরিকল্পনা নেই। এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো ক্ষেত্রবিশেষে ছোটখাটো দুর্নীতিবাজেরা শাস্তি পেলেও বড় দুর্নীতিবাজেরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কিংবা ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, গণমাধ্যমসহ যারা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করে, তাদের জন্য দেশে প্রতিকূল ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি ও পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এ-ই যখন সরকারের নীতি হয়ে পড়ে, তখন দুর্নীতির সূচক লম্ফ দিয়ে বাড়বে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে।

দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান দুদকের একজন কমিশনার প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘দুর্নীতির বিষয়ে টিআই যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা অস্বীকার করছি না।’ এ কথা সত্য যে দুর্নীতি বন্ধের কাজ একা দুদক করতে পারবে না; রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যদি টিআইয়ের প্রতিবেদন অস্বীকার না করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন, তাহলে দুর্নীতির ঊর্ধ্বগামী সূচক কিছুটা হলেও নিম্নগামী করা সম্ভব। আর তাঁরা যদি বরাবরের মতো অস্বীকার করতে থাকেন, তাহলে দুর্নীতিতে ফের চ্যাম্পিয়ন হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।