গৃহহীনের আশ্রয়দান নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গুচ্ছগ্রাম নির্মিত হয়েছিল। তবে খুলনার কয়রা উপজেলার গুচ্ছগ্রামগুলোর বর্তমান অবস্থা কেবল নীতিগত ব্যর্থতার নিদর্শন নয়, বরং এটি আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার টেকসই কাঠামোর দুর্বলতাকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করছে। এখানকার গুচ্ছগ্রামগুলোর বিদ্যমান অবস্থায় প্রতীয়মান হয়, এ প্রকল্প কেবল কাগজে-কলমেই সুচিন্তিত ছিল; বাস্তবায়নোত্তর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুদূরপ্রসারী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রাকৃতিকভাবে দুর্গম চরে প্রতিষ্ঠিত এসব বসতি ক্রমান্বয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা অনুপস্থিত, নলকূপ অকেজো, বিদ্যুতের সংযোগ অপ্রতুল এবং ঘরগুলোর ভৌত অবকাঠামো ভঙ্গুর। মৌলিক নাগরিক সুবিধার অভাব এতটাই প্রকট যে হতাশাগ্রস্ত বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে গুচ্ছগ্রাম পরিত্যাগ করছেন; যা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে।
গুচ্ছগ্রাম নির্মাণের মুখ্য লক্ষ্য ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনগণকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। জোয়ারের তোড়ে ঘরগুলোর মেঝে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, টিনের বেড়া ক্ষয়ে পড়ছে এবং বৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এসব সমস্যার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। বরাদ্দের সংকটকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হলেও প্রকল্প প্রণয়নের সময় যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে হয়তো আজকের এ দুরবস্থা দেখতে হতো না।
শুধু গৃহনির্মাণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং সেগুলোর স্থায়িত্ব, মৌলিক সুবিধা সংযোজন এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কয়রার গুচ্ছগ্রামের অধিবাসীরা এসব মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
অতএব, এ সংকট নিরসনের লক্ষ্যে কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। প্রথমত, গুচ্ছগ্রামের প্রতিটি ঘরের কাঠামো সুদৃঢ় করতে হবে এবং ভূমি স্থায়িত্বশীল করতে মেঝে পাকা করা অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে আধুনিক নলকূপ স্থাপন ও বিদ্যমান নলকূপ সংস্কার করা আবশ্যক। তৃতীয়ত, বিদ্যুৎ–সংযোগের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন একান্ত জরুরি। চতুর্থত, গুচ্ছগ্রামসমূহকে বাসযোগ্য রাখতে অভ্যন্তরীণ সংযোগ সড়ক সংস্কার ও পর্যাপ্ত পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা আরও সুসংহত ও ফলপ্রসূ হওয়া প্রয়োজন। কেবল প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেই দায়িত্ব সম্পন্ন হয় না, বরং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে কার্যকর তদারকির ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্রুত সমন্বয় সাধন করে বরাদ্দ নিশ্চিত করা গেলে এখানকার অধিবাসীদের দুর্দশা লাঘব সম্ভব। অন্যথায়, এ প্রকল্প ব্যর্থ উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রতীকে পরিণত হবে এবং ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গৃহীত এ ধরনের কর্মসূচি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।