বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কী করছে

সম্পাদকীয়

শুক্রবার ‘বাংলাদেশ মার্কেটিং ডে’র অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘বাজারের সিন্ডিকেট যদি দেখতে পারতাম, ধরতে পারতাম, তাহলে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’ একই সঙ্গে তিনি উদীয়মান অর্থনীতিতে বাজারের গতি-প্রকৃতি কী হয়, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।

বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে এর আগেও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। কেউ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ থাকতে বলেছেন। আবার কেউ বাজার সিন্ডিকেট ধরতে গেলে সমূহ সর্বনাশ হতে পারে বলে সতর্কও করে দিয়েছেন।

প্রথম আলোর খবরে দেখা যায়, আলু, পেঁয়াজ, ডিম, খোলা চিনি, সয়াবিন তেল ও রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার—এই ছয় পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর করা যায়নি। পাঁচটি পণ্যই ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেশি দামে। কেন এমন পরিস্থিতি হলো, এর পেছনে সরকারের কোনো ভুল নীতি কিংবা সমন্বয়হীনতা ছিল কি না, সেটাও দেখার বিষয়।

কোনো পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা অমার্জনীয় অপরাধ। আলু বা ডিমের ক্ষেত্রে সেটি কারা করেছে, খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। এ বিষয়ে সরকারের টেকসই কোনো পদক্ষেপের কথা জানা নেই। যখনই বাজারে কোনো পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়, বিক্ষিপ্তভাবে অভিযান চালাতে দেখা যায়।

দু–চারজন চুনোপুঁটিকে জরিমানা করা হলেও রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরও দাম না কমা দুর্ভাগ্যজনক। এ বিষয়ে খুদে খামারিদের অভিযোগগুলোও আমলে নেওয়া উচিত বলে মনে করি।

ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই মুনাফা করবেন, কিন্তু সেই মুনাফা লাগামছাড়া হতে পারে না। কিছু নিয়মকানুনের মধ্যেই তাঁদের ব্যবসা করতে হবে। যেসব দেশে সরকারের নিজস্ব সরবরাহব্যবস্থা জোরদার রয়েছে, সেসব দেশে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করতে পারেন না। আমাদের দেশে বিকল্প সরবরাহব্যবস্থা খুবই দুর্বল।

সরকার টিসিবির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম দামে কিছু পণ্য সরবরাহ করলেও তা চাহিদার তুলনায় এত কম যে বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে না। একসময় বাংলাদেশে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু ছিল; ফলে সরকার–নির্ধারিত সাশ্রয়ী দামে তঁারা নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্য পেতেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সেটি তুলে দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রীর ভাষায় ‘অধরা ও অদেখা বাজার সিন্ডিকেট’ নানা কৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কয়েকটি বড় কোম্পানিই বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকে এবং তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। যখন এসব বড় ব্যবসায়ী মনে করেন সরকার তাঁদের ওপর নির্ভরশীল, তখন তাঁরা ক্রেতাসাধারণের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখেন।

আরেকটি সমস্যা হলো আমাদের দুর্বল বিপণনব্যবস্থা। ক্রেতাসাধারণকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হলেও উৎপাদক বা কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। আগে পণ্য পরিবহনে বিলম্ব ও বাড়তি খরচের দোহাই দেওয়া হতো। গত দেড় দশকে সরকার সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে বলে মন্ত্রীদের দাবি।

তারপরও উৎপাদক যে দামে পণ্য বিক্রি করেন, ক্রেতাকে তার দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে কিনতে হচ্ছে। বাজারব্যবস্থাপনায় চরম নৈরাজ্যের কারণেই এটা হচ্ছে এবং তৃতীয় পক্ষ লাভের গুড় পুরোটা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর প্রতিকারে কি সরকারের কিছুই করার নেই?