পানি না পেলে কৃষকেরা চাষ করবেন কীভাবে

সম্পাদকীয়

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের প্রধান পাম্পহাউসের ভেতর থাকা তিনটি সেচপাম্পের সব কটি অচল থাকার খবরটিই আমাদের কৃষক ও কৃষির একমাত্র দুঃসংবাদ নয়; একই সঙ্গে রাজশাহী ও রংপুরের ১৬ জেলায় বিএমডিএর আওতাধীন কৃষকেরাও সেচের পানির অভাবে ঠিকমতো চাষাবাদ করতে পারছেন না।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় তিনটি পাম্পের সাহায্যে পানি দেওয়া হতো। কয়েক বছর ধরে দুটি পাম্প বন্ধ ছিল। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গা—এই চার উপজেলার কৃষকেরা দুর্ভোগে পড়েছেন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারছেন না, কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। কেউ কেউ শ্যালো মেশিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন। এতে ধান উৎপাদনে খরচ ১২ থেকে ১৫ গুণ বেড়ে গেছে।

কবে নাগাদ পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হবে, তা বলতে পারছেন না পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। পদ্মায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় তিন-চার বছর আগে থেকে বোরো মৌসুমে শুধু কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়। মাগুরা ও ঝিনাইদহের খালগুলোর কপাট বন্ধ রাখা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জিকে সেচ প্রকল্পের পানিতে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলার অন্তত ১ লাখ ৬ হাজার কৃষক বোরো আবাদ করতে পারতেন।

আলমডাঙ্গা উপজেলার হাউসপুর গ্রামের একজন বর্গাচাষি বলেছেন, ‘খালের পানির জন্যি গুনতি হয় ২০০ ট্যাকা। এবেড্ডা (এবার) ছ্যালো মেশিন ভাড়া বাবদ দিতি হবে এক মণ ধান। সাথে ৫ হাজার ট্যাকার ডিজেল কিনতি হবে। জমির মালিকির দিতি হবে ৮ মণ ধান। সপ নিয়ে চিন্তায় আচি।’

এ আক্ষেপ কেবল তাঁর নয়; প্রকল্পের অধীন প্রায় সব কৃষকের অবস্থা একই রকম। পদ্মায় এমনিতেই পানি কম; তারপরও সেতু নির্মাণের নামে ভেড়ামারার প্রধান খালটি ভরাট করার কারণে আশপাশের কৃষকেরা সেচের পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখার বিরোধী নই আমরা। কিন্তু সেটি সেচের খাল ভরাট করে হতে পারে না।

এদিকে বরেন্দ্র এলাকায় বিএমডিএর গভীর নলকূপগুলোয় ঠিকমতো পানি না ওঠায় রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকদের চাষাবাদও ব্যাহত হচ্ছে। বহু বছর ধরেই এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। একসময় ১৬০ ফুট অ্যাকুইফার (পানির জলধারক স্তর) ছিল, সেখানে এখন ৬ ফুটে নেমে এসেছে। উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে রাজশাহী অঞ্চলে দুই সাঁওতাল কৃষক সেচের পানি না পেয়ে মাঠেই বিষপানে আত্মহত্যা করেছিলেন।

কেবল এ দুই অঞ্চলেই নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও কৃষকেরা বিপদে আছেন। যখন বোরো মৌসুম আসে, তখনই কর্মকর্তারা নড়চড়ে বসেন। কিন্তু কৃষি প্রকল্পাধীন নদী ও খালগুলোর পানি সরবরাহ কিংবা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ধরে রাখার কোনো টেকসই পরিকল্পনার কথা জানা যায় না। একটি সেচপাম্প পুরোনো হওয়ার কারণে পাম্পহাউস অচল থাকা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সরকার কেন পুরোনো পাম্পটির স্থলে একটি নতুন পাম্প স্থাপন করল না?

যে কৃষি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে, ১৭ কোটি মানুষের আহার জোগাচ্ছে, সেই কৃষির প্রতি সরকারের এ অবহেলা মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের অচল পাম্প সচল এবং বিএমডিএর আওতাধীন কৃষকদের স্বল্প মূল্যে সেচসুবিধা দেওয়া হোক।