উদ্যান ধ্বংস করে দিঘি বাঁচানো যাবে না

সম্পাদকীয়

যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে এর প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল আগেই হিসাব করে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের অনেক প্রকল্পেই দেখা যায় লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ‘আলতাদিঘি পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ৮ মে প্রথম আলোয় ‘টলটলে দিঘি এখন মরুভূমি’ শিরোনামে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ও পরের ফারাকটি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। পুনঃখননের আগে আলতাদিঘির চারপাশে ছিল ঘন সবুজের সমারোহ, চারপাশে হাজার হাজার গাছ। আর পরের ছবিতে দেখা যায়, দিঘির আশপাশ কার্যত গাছশূন্য, যেন বিরানভূমি।

গত বছর নভেম্বর মাসে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬ কোটি ৩৯ টাকা ব্যয়ে দিঘির পুনঃখননের কাজ শুরু হয়। সাবেক বনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন এটি উদ্বোধন করেন। ২০১১ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়।

বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ১ হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫০০ মিটার প্রস্থ আলতাদিঘি পুনঃখননের উদ্দেশ্যে প্রায় ১ হাজার ১০২টি গাছ কাটা হয়েছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, গাছ কাটা হয়েছে তিন হাজারের বেশি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণিগাছ কাটা হয়েছে এবং দেশীয় প্রজাতির চারা দিয়ে সেটি পূরণ করা হবে। পরিবেশবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই গাছ কেন লাগানো হয়েছিল?

আলতাদিঘি পুনঃখননের নামে গাছ কাটার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন পরিবেশবাদীরাও। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নওগাঁ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাফকুল ইসলাম বলেন, সৌন্দর্যবর্ধন বৃক্ষরোপণের মধ্যে নিহিত, নিধনে নয়। কাটা গাছগুলো হতে সময় লেগেছে ১৫ থেকে ২০ বছর। অথচ নিমেষের মধ্যে তা ধ্বংস করা হলো।

দিঘি পুনঃখনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমরা নই। কিন্তু সেটা করতে হবে প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা জাতীয় উদ্যান বাঁচিয়েই। একবার বনায়নের নামে গাছ লাগানো, আরেকবার দিঘি খননের নামে সেই গাছ কেটে ফেলার মহড়া চলতে পারে না। গাছ বিক্রি করে বন বিভাগ যে অর্থ পেয়েছে, ক্ষতির পরিমাণটি তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।

পরিবেশবাদীদের মতে, বিপুলসংখ্যক গাছ না কেটেও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পুকুরটি খনন করা যেত। কিন্তু বন বিভাগ সেই পথে না গিয়ে গাছ কাটার সহজ পথ বেছে নিয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বিচার দিঘির চারপাশের গাছ কাটার ফলে সেখানকার পাখিরাও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত যশোরে ২ হাজার ৪৪টি গাছ কাটার খবরের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ রক্ষায় গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে ঢাকাসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাত সদস্যবিশিষ্ট পৃথক কমিটি গঠন প্রশ্নে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। গাছ কাটার কারণে যেখানে উচ্চ আদালত রুল জারি করেছেন, সেখানে একটি জাতীয় উদ্যাানের গাছ নির্বিচার কেটে ফেলা অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করি। এর পেছনে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর অন্য কোনো বদমতলব আছে কি না, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। উদ্যান ধ্বংস করে দিঘি বাঁচানো যাবে না।

যে জলবায়ু পরিবর্তনের তহবিল দেওয়া হয়েছে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য, কিন্তু সেই তহবিলের অর্থ দিয়ে এ রকম পরিবেশবিনাশী কাজ চলতে পারে না। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।