আমদানির সিদ্ধান্ত কেন আগে নেওয়া হয়নি

সম্পাদকীয়

ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেওয়ার খবরে দেশের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম দ্রুত কমছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ঢাকার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের ও শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবসহ ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে গত শনিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

পেঁয়াজ আমদানি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা থেকে আমদানির অনুমতি বা আইপি নিতে হয়। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে গত ১৫ মার্চ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া বন্ধ রেখেছিল মন্ত্রণালয়।

পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া নিয়ে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চাপান–উতোর চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। বাণিজ্যসচিব গত ১৪ মে সীমিত পর্যায়ে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে কৃষিসচিবকে চিঠি পাঠান। সে সময়ে পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, যা এক মাস আগের তুলনায় দ্বিগুণ। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় রোববার প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেনাবেচা হয়েছে ৯০–১০০ টাকা দরে।

পেঁয়াজের আমদানি নিয়ে এই জটিলতা সৃষ্টির পেছনে আছে উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে তথ্যগত বিভ্রান্তি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। বর্তমানে মজুত আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। কৃষি বিভাগের তথ্য সঠিক হলে পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাস্তবে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

ব্যবসায়ীদের মতে, দেশে চাহিদার ৭০ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০২১–২২ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ২৫ লাখ টনের কিছু বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি অনুযায়ী, বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। সেই দাবি সত্য হয়ে থাকলে দাম দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি হওয়ার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকার কথা নয়।

কিছুদিন আগে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, দেশে প্রচুর পেঁয়াজ মজুত আছে, আমদানির প্রয়োজন নেই। সেই সঙ্গে তিনিও এ–ও জানিয়ে দিয়েছিলেন, দাম না কমলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু যখন অনুমতি পাওয়া গেল, তখন পেঁয়াজের দাম শতকের ঘর পূরণ করেছে। অসাধু গোষ্ঠী এরই মধ্যে যা হাতিয়ে নেওয়ার নিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধ অনুযায়ী, মে মাসের মাঝামাঝি আমদানির সিদ্ধান্ত নিলে এভাবে ক্রেতাসাধারণের পকেট কাটা যেত না।

কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষকের স্বার্থ নিশ্চয়ই দেখবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ক্রেতার স্বার্থ দেখবে। কিন্তু দুই পক্ষের দুই দেখার মধ্যে বড় ধরনের গরমিল হয়ে গেলে সাধারণ ভোক্তাদের দুর্গতির শেষ থাকে না। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।

কৃষককে সুরক্ষা দিতে এমনভাবে পেঁয়াজ আমদানির শুল্কহার ঠিক করতে হবে, যাতে আমদানিমূল্য দেশে উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি হয়—বাণিজ্য বিশ্লেষকদের এই মত সাধারণ ভোক্তাশ্রেণির স্বার্থেই সরকারের বিবেচনায় রাখা দরকার। এতে আমদানিও হবে, আবার দামও কমে যাবে না।

ভারতীয় পেঁয়াজ আসা শুরু হলে বাজারে পেঁয়াজের দাম কমবে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, দুই মাস ধরে ক্রেতাদের যে পকেট কাটা গেল, তার দায় কৃষি মন্ত্রণালয় এড়াবে কীভাবে?

ভুলে গেলে চলবে না, দেশে এখন প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম চড়া। মূল্যস্ফীতি মে মাসে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে (৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ)। এ সময় যেখানে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার সুযোগ আছে, সেখানে সময়ক্ষেপণ কেন?