ঢাকার কেরানীগঞ্জে একটি মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ ও নিউ ইস্কাটনে ককটেল হামলায় তরুণ নিহতের ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ নেই। ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটনা দুটি ঘটলেও এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনপূর্ব দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুর চিত্রই বেরিয়ে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য এটি কঠোর সতর্কবার্তা বলেই আমরা মনে করি।
গত শুক্রবার সকালে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায় একতলা ভবনে বিস্ফোরণে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে। এ ঘটনায় মাদ্রাসার পরিচালক আল-আমিন স্ত্রী ও সন্তানদের হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় আগেও তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্যে জানা যায়, বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটা বেশি ছিল যে ভবনটির ইট উড়ে গিয়ে ২০০ ফুট দূরের আরেকটি ভবনে আঘাত করে। মাদ্রাসাটিতে ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। শুক্রবার ছুটির দিন না হলে নিশ্চিত করেই হতাহতের সংখ্যা বাড়ত। ঘটনাস্থল থেকে ৪০০ লিটারের মতো বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পাওয়া গেছে, যার মধ্যে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিকও রয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
আল-আমিন পলাতক আসামি, তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় ২০১৭ ও ২০২০ সালে দুবার গ্রেপ্তার হন এবং দুই দফা কারাগারে ছিলেন। ২০২৩ সালে জামিনে মুক্তি পান। এ রকম একজন আসামি কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের নিয়মিত নজরদারি ও তদারকির বাইরে থাকতে পারেন, সেটা মোটেই বোধগম্য নয়। বিস্ফোরণ ও রাসায়নিকের মজুত ঘিরে যে নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হলো, তার জবাবদিহি কে করবে?
চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে-পরে বিভিন্ন কারাগার থেকে যে আসামি ও কয়েদি পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীরাও ছিলেন। তাঁদের অনেককে আর গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থার সুযোগে অনেকে জামিনেও বের হয়ে আসেন। তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে মব সহিংসতা উসকে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে।
বিগত সরকারের আমলে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থা সমস্যাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ঢালাওভাবে ব্যবহার করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সরকার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিক থেকে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডকে খাটো করে দেখানোর একটা প্রবণতা দেখা গেছে। আমরা মনে করি, সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থাকে প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কিংবা খাটো করে দেখানোর সুযোগ নেই।
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে গত বুধবার সন্ধ্যায় উড়ালসড়ক থেকে ছোড়া ককটেলের বিস্ফোরণে সিয়াম মজুমদার নামের এক তরুণ নিহত হন। ঋণগ্রস্ত হয়ে সিয়ামের পরিবার খুলনার গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিল। ছেলেকে হারিয়ে মা সিজু বেগমের ‘ঢাকায় আইস্যা সব শ্যাষ হইয়া গেল’—এই আর্তনাদ নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। নভেম্বর মাসে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ডাকা কর্মসূচির সময় ককটেল বিস্ফোরণের মতো নাশকতা বেড়েছিল। ফলে এই হামলার সঙ্গে কারা জড়িত, অবশ্যই তদন্ত করে বের করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ককটেল হামলাকারীদের এখন পর্যন্ত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হত্যাকাণ্ড, সহিংসতার কারণে এমনিতেই আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনা তাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। গতকাল সোমবার ছিল মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও দাখিলের শেষ দিন। সরকারকে অবশ্যই জননিরাপত্তায় হুমকি তৈরি করতে পারে, এমন তালিকাভুক্ত আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।