তদন্ত কমিটি না হওয়ার কারণ কী

সম্পাদকীয়

পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক, উদ্বেগজনক ও নিন্দনীয়। কোনো সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় আয়োজনকে কেন্দ্র করে দুজন তরুণের প্রাণহানি, প্রায় দুই শ বাড়িঘর ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা কীভাবে ঘটল?

এর আগে ২০১৯ সালেও জলসা ঘিরে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এবারও আহমদিয়া সম্প্রদায় ৩ ও ৪ মার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করার পরই কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন জলসা বন্ধের দাবি জানাতে থাকে। বৃহস্পতিবার তারা শহরে বিভিন্ন সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করে। অন্যদিকে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে জলসায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়। প্রশাসন থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয় যে তারা জলসা করতে পারে, কোনো সমস্যা হবে না।

যে জলসার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে চার-পাঁচটি সংগঠন মাঠে নেমেছে, সেই জলসাকে কেন্দ্র করে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, প্রশাসনের তা মাথায় রাখা উচিত ছিল। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিভিন্ন মসজিদ থেকে মুসল্লিরা বিক্ষোভ করে জলসাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর পুলিশ তাঁদের বাধা দিলে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় এবং দুজন মারা যান। বৃহস্পতিবার থেকেই উত্তেজনা দেখা দেয় এবং একশ্রেণির লোক আহমদিয়াদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় এবং লুটপাট করে। শনিবার আবার গুজব ছড়িয়ে অনেককে রাস্তায় নামানো হয়। তারা একটি জুতার দোকানও লুটপাট করে।

আহমদিয়া জামাত নিজেদের ইসলামের অনুসারী মনে করে। কিন্তু মুসলমানদের একটি অংশ তাদের মুসলমান হিসেবে স্বীকার করে না। এটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। এ নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু কোনো সম্প্রদায়কে জলসা করতে না দেওয়া কিংবা বাড়িঘরে হামলা চালানো কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য কাজ হতে পারে না।

আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত। প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কারও ধর্ম পালনে রাষ্ট্র ও মহলবিশেষ বাধা দিতে পারে না; যদিও ধর্মের নামে একশ্রেণির লোক সেই কাজই করে আসছে। পঞ্চগড়ে বিক্ষোভকারী সংগঠনগুলো বলেছে, তারা রাস্তায় প্রতিবাদ করলেও আহমদিয়াদের বাড়িঘরে হামলা চালায়নি। তাহলে কারা এ কাজ করেছে, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকার যেখানে ছোটখাটো ঘটনায়ও একাধিক তদন্ত কমিটি করে, সেখানে পঞ্চগড়ের প্রাণঘাতী ঘটনায় তদন্ত কমিটি না করার কী কারণ থাকতে পারে?

পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম জ্বালাও-পোড়াওয়ের দায় যেভাবে বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছেন, সেটা নিন্দনীয়। অথচ তিনি সোমবার যাঁদের নিয়ে আহম্মদনগর সফর করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই হামলার অভিযোগ করেছেন আক্রান্ত আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। আমরা চাই যে দলেরই হোক না কেন, যে বা যারা অপকর্মে লিপ্ত হবে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তদন্তের আগেই যদি অপরাধী চিহ্নিত করা হয়, তাহলে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি ব্যাহত হয়, এমন কোনো কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। পঞ্চগড়ে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যঁাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ তাঁদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে আমরা মনে করি, পঞ্চগড়ের স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি সামাল দিতে ও আগেভাগে ব্যবস্থা নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন  করা জরুরি।