নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে তদন্ত হোক

সম্পাদকীয়

উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান ও অভিভাবক। বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়মকানুন মেনে চলবে কি না, তা অনেকটা তাঁর ওপর নির্ভর করে। কিন্তু উপাচার্য নিজেই যদি নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো চলার কোনো কারণ নেই।

সাম্প্রতিক কালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে তা কেবল উদ্বেগজনক নয়; ক্ষেত্রবিশেষে লজ্জাকরও। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ১৯ মার্চ থেকে উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মইনের অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন করে আসছেন। একই সঙ্গে তাঁরা মানববন্ধন করেছেন। উপাচার্যের দপ্তরে বহিরাগত ও পেটোয়া বাহিনীর হাতে শিক্ষকেরা লাঞ্ছিত হন। এর আগেও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির বিরোধ ক্লাস বর্জনে রূপ নিয়েছে।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য শিরীণ আখতার মেয়াদের শেষ দিনে ৩৭ জনকে কোনো নিয়মনীতি না মেনেই নিয়োগ দিয়ে যান, যাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরাও আছেন। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার তাঁর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ার ছবি ভাইরাল হয়েছে, যা যেকোনো ব্যক্তি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অপমানকর। সাবেক এই উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ছাত্রলীগের মাস্তানি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাঁর সময়ে ছাত্রলীগের উপদলীয় কোন্দলে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ দায়িত্বে থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগ–বাণিজ্যের অভিযোগ এনে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদস্যরা তাঁর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীদের হাতে উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী নিগৃহীত হয়েছেন বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

কেবল এই তিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই যে উপাচার্যরা অনিয়ম করছেন, তা–ই নয়। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রথম কাজ হয়ে পড়ে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির নেতা–কর্মীদের তোয়াজ করা এবং তাঁদের অন্যায় আবদার পূরণ করা। তাঁদের দ্বিতীয় কাজ হলো শিক্ষক–কর্মচারীদের মধ্যে নিজস্ব বলয় তৈরি করা। যাঁরা এই বলয়ের বাইরে থাকবেন, তাঁদের নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তাঁর ভাষায় ছাত্রলীগের চাপে ৩৭ জনকে নিয়োগ দিয়ে দ্বিতীয় নজির সৃষ্টি করেছেন। প্রথম নজির সৃষ্টি করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক উপাচার্য।

এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ–বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিয়ে ইউজিসি তদন্তও করছে। অনেক উপাচার্য ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সরদার’ ইউজিসির তদন্তকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আবার কেউ কেউ তদন্তকাজই করতে দেননি। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীকেও চ্যালেঞ্জ করেছেন। এসব উপাচার্যের খুঁটির জোর ইউজিসি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের চেয়েও বেশি।

অতীতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ছাত্র–শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছে। সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হোক, সেটা কোনোভাবে কাম্য নয়। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, এভাবে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে পারে না। উপাচার্যদের কারণে যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস–পরীক্ষা বন্ধ থাকে, তার ক্ষতি কী করে পোষানো হবে? উপাচার্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি তথা নিয়োগ–বাণিজ্যের যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো তদন্ত করতে হবে নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে। প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক।