বড় কথা ছেড়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন

সম্পাদকীয়

বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতিশ্রুতি, ছোট-বড় প্রকল্প, বড় বরাদ্দ—কোনো আয়োজনেরই কমতি নেই। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত ও সামগ্রিক পরিকল্পনা না থাকায় নাগরিক ভোগান্তি তো কমেইনি, বরং বেড়েছে বহুগুণ। যার সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত দেখা গেল গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে রাতের বৃষ্টিতে।

১২২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ঢাকার অধিকাংশ এলাকাজুড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় গোটা শহর প্রায় অচল হয় পড়ে। ঘরে ফেরা মানুষ পড়েন অবর্ণনীয় দুর্ভোগে। ডেসকোর বিদ্যুতের তার সড়কের জমে থাকা পানিতে ছিঁড়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান নারী ও শিশুসহ চারজন।

২০২১ সালে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাতে যায়। তিন বছরে এ খাতে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ও হয়েছে। সম্প্রতি দক্ষিণ সিটির মেয়র আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঢাকায় বৃষ্টির পানি ১৫ মিনিটের মধ্যে অপসারণ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বৃষ্টি শেষ হওয়ার ১৫ ঘণ্টা পরও পানিতে ডুবে থাকে নিউমার্কেটসহ অনেক এলাকা।

ভারী বৃষ্টি হলে ঢাকার সড়ক ও অলিগলিতে পানি জমা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সেই পানি সরতে পরদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবে কেন? প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ঢাকার বৃষ্টির পানি অপসারণ করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্পসহ যা যা প্রয়োজন, সবকিছুই দুই সিটি করপোরেশনের কাছে রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় না বলেই ভোগান্তির চক্রব্যূহ থেকে ঢাকাবাসীর পরিত্রাণ মেলে না।

বৃষ্টি হলে ঢাকার ভেতরকার পানি পাম্পহাউস, স্লুইসগেট ও খালের মাধ্যমে আশপাশের নদ–নদীতে গিয়ে পড়ে। এর মধ্যে কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন দক্ষিণ সিটির পাম্পস্টেশন দিয়ে মিনিটে ৮ লাখ ৫৫ হাজার লিটার পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব। অথচ সেই স্টেশনের সক্ষমতার বেশির ভাগই কাজে আসছে না। এর কারণ হলো পাম্পস্টেশনে পানি পৌঁছানোর নালা–নর্দমা ও বক্স কালভার্ট পুরোপুরি সচল নয় কিংবা ভরাট হয়ে গেছে। পুরান ঢাকার ধোলাইখালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে থাকা আরেকটি পাম্পস্টেশনের অবস্থা একই।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে পাওয়া ৫৫টি স্লুইসগেটের সক্ষমতাকেও কাজে লাগাতে পারছে না দুই সিটি করপোরেশন। বর্জ্য জমে পাইপলাইন দিয়ে স্লুইসগেটে ঠিকমতো পানি পৌঁছাতে পারে না। কিছু পাইপলাইনের জায়গা দখল হয়ে গেছে। আবার জনবলসংকটের কারণে স্লুইসগেটগুলো রক্ষণাবেক্ষণও হয় না।

জনঘনত্বের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের প্রথম ও জনসংখ্যার দিক থেকে সপ্তম নগর হলেও এখানকার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক কিছুটা তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার আগে এবং কিছুটা নব্বইয়ের দশকে। চারপাশে নদী এবং মাঝখানে জালের মতো বিছানো খাল—প্রাকৃতিকভাবেই ঢাকায় বৃষ্টির পানি একসময় নেমে যেত। কিন্তু জেলা প্রশাসনের খাতায় থাকা ৫৮টি খালের সিংহভাগই এখন ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। নানা সময় সেসব খাল পুনরুদ্ধারের তোড়জোড় দেখা গেলেও দিন শেষে অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন দেখা যায় না।

একটি নগরের মোট আয়তনের ১২ শতাংশ জলাধার থাকা প্রয়োজন, ঢাকায় সেখানে জলাধার ২ শতাংশের কম। এ কারণে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এ বাস্তবতায় ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সচল করা ছাড়া ঢাকাকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচানোর কোনো বিকল্প পথ নেই।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘যেখানেই জলাবদ্ধতা সেখানেই প্রকল্প’—এই যে হাতুড়ে নীতিতে এগিয়েছে, সেটা বাস্তবে কার্যকর ও টেকসই পরিকল্পনা নয়। তাদের এই ভুল নীতির খেসারত নাগরিকদেরই দিতে হচ্ছে। আত্মতুষ্টি ও বাগাড়ম্বর থেকে বেরিয়ে এসে কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন। নিয়মিতভাবে জলাধার সংরক্ষণ, খাল খনন ও কালভার্ট পরিষ্কারের পদক্ষেপ নিন।